আহনাফ জান্নাত পূর্ণতা :: গত বছর কক্সবাজার নামার আগে এবং কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার সময় পরপর দু’ দিন Novo Air এর বিমানের ঝাঁকিটা এখনো কাঁপিয়ে তোলে। কক্সবাজার ল্যান্ড করবার আগ মুহূর্তে প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ি। বৃষ্টিতে রানওয়ে ঠিক মত দেখতে পাচ্ছিলেন না পাইলট। ৩৫ মিনিটের মত শূন্যে ভেসে থাকতে হল। একেরপর এক বজ্রপাতে মনে হচ্ছিল বিমানটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
পরদিন ফেরবার সময় মাঝপথেই শুরু হল ঝড়। হঠাৎ করেই পেটের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠলো সবকিছু। কয়েকশ ফুট নীচে না বলেই নেমে গেলো বিমান। ভয়ে সহযাত্রীদের অনেকেই কেঁদে উঠল। কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। ঐ মুহূর্তটাতে মনে হচ্ছিলো, আর হয়ত এই চোখ খোলা হবে না আমার!
মৃত্যু হঠাৎ আসবে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই যে বসে থেকে যে কাঁপুনি, অস্থিরতা, মেরুদন্ড বেয়ে বরফের চাঁই নেমে যাওয়া এবং বুঝতে পারা হয়তো পরের সেকেন্ডে দুনিয়াটা শেষ হয়ে যাবে; এই অনুভূতি বর্ণনাহীন।
ত্রিভূবন বিমানবন্দরে যে ভাগ্যাহতরা এখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন কোন হিমাগারে, তাদের অবস্থা তেমনই ছিল।
কল্পনা করছি। আর ঘামছি। হয়তো ছোট বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে মা-বাবা কাঁদছিলেন। চিৎকার করছিলেন। আল্লাহকে ডাকছিলেন। মিরাকলের আশায় ছিলেন!
মধুচন্দ্রিমায় যে জুটি গিয়েছিল, তারা দুজনের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল। কখন অজান্তে চামড়া কেটে রক্ত বেড়িয়েছে সে খেয়াল নেই কারও। হয়ত শেষ চুম্বন, শেষবার মাথাটা বুকে টেনে নেয়া।
জানি না কতটা সময় পেয়েছে তাঁরা। শেষ মুহূর্তগুলো কি মর্মান্তিক। জীবনের শেষ পাতা। যাদের জীবনের শেষভাগ হঠাৎই চিন্তার চেয়ে কাছে চলে এসেছে, তারা বিস্মিত হয়ে দেখছিলেন নিজের জীবনটা বড় একটা কক্ষে ৬০জন যাত্রীর সঙ্গে শেষ হচ্ছে। কিভাবে, কেমন ভাবে সেটা ভেবে আতঙ্কে তারা ডুকরে কেঁদেছেন। এভারেস্ট দেখতে এসে তাঁদের আরো অনেক উঁচুতে যেতে হবে সেটা কল্পনাসীমার ভেতরেই আসেনি কখনো।
আমি এই চিন্তা করতে গিয়ে অভিভূত হয়ে যাচ্ছি। বিমানটা নামছে। জীবনের সব লাগাম আলগা হয়ে যাচ্ছে। এক মূহুর্তের মধ্যে তাতে আগুন লাগলো। পুড়তে থাকলো অনেক জীবন। স্বপ্ন।
আহ স্বপ্ন। স্বপ্নেরা যদি আজ ডানা মেলে বিমানের আহত ডানায় বা চাকায় হাওয়া দিতো তবে এ দিনটা বাংলাদেশকে দেখতে হতো না। অনেক পরিবারের ভেতর কি যাচ্ছে তা স্বয়ং ওপরওয়ালা ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাঁর ওপর এ কারনে বড় অভিমান হয়। কেনোই বা আনো আর কেনোই বা নিয়ে যাও?
আজ বাংলাদেশের শোকে তলিয়ে যাওয়ার দিন। নিজের দেশে পথে রওয়ানা দিয়ে যে নেপালি ছাত্র-ছাত্রীরা এক ফুঁতে জীবন হারালেন, তাদের জন্য শোক গাথা। সবার জন্য। সবার বিদেহী আত্মার জন্য প্রার্থনা।
আহ বাচ্চাটা, কি মায়া মুখে চোখে পানি নিয়ে তাকিয়ে ছিল একটা সুপারম্যান এসে বিমানটা ঠিকক নামাবে এ আশায়!
আমি জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না।
লেখক: পি.আর ডিরেক্টর, ভিশন ব্লু ইনকর্পোরেশান, নিউ ইয়ার্ক। a2zpurnata@gmail.com