‘শৈশবেই ডিজিটাল শিক্ষার হাতেখড়ি’

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী)প্রতিনিধি :: সাগর ঘেষা চরাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়িতে এখনও বিদ্যুতের আলো জ্বলে না। কিন্তু সেই বাড়ির ছোট্র্র শিশুটি স্কুলে গিয়ে প্রযুক্তির সাহায্যে শিখছে ছড়া, কবিতা ও বর্ণমালা। কার্টুন দেখে দেখে হাতের আঙ্গুল গুনে শিখছে অংক। আদুরে গলায় গাইছে জাতীয় সংগীত ও ছড়া গান।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার চরাঞ্চল বেষ্টিত ধুলাসার ইউনিয়নের ধুলাসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক ক্লাসে গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় প্রযুক্তির সাহায্যে শেখা শিশু শিক্ষার্থীদের এ প্রতিভা।

স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান ও শিক্ষিকা সোনিয়া সুলতানার প্রচেষ্টায় এ বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীদের শৈশবেই ডিজিটাল শিক্ষার হাতেখড়ি হচ্ছে।

“শিশুদের পিঠে বড় ব্যাগ আর ভারী ওজনের বইপত্র আর নয়, শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা হবে ডিভাইসে” এ শ্লোগান নিয়ে সাগর ঘেষা এ বিদ্যালয়ে এ বছর শুরু হয় এ প্রযুক্তি শিক্ষা। সরকারি ডিজিটাল শিক্ষার উপকরণ হিসেবে এ বিদ্যালয়ে একটি ল্যাপটপ বিতরণ করা হলেও এখনও প্রজেক্টর সরবরাহ না করায় শিক্ষিকা সোনিয়া সুলতানার প্রচেষ্টায় নিজের ট্যাব দিয়ে শুরু করেণ এ “প্রযুক্তি শিক্ষা”।

ইউনিসেফের সহায়তায় সিএফএস ও এসইএম ভূক্ত বিদ্যালয় হিসেবে তালিকাভূক্ত ধুলাসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। উপজেলার ১০টি বিদ্যালয়কে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয় “শিশুবান্ধব বিদ্যালয়” হিসেবে। এ প্রকল্পের আওতায় এ বিদ্যালয়ের প্রাক প্রাথমিক শ্রেণি কক্ষ এখন শিশুদ্যাণে রুপান্তর করা হয়েছে। সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বর্ণমালা, ছড়া, গল্প ও কবিতা। দেয়ালে ছবি অংকন করায় শিশুরাই ছবি দেখে শিখছে প্রানী,ফুল,ফল ও পাখির নাম। শিক্ষিকা ক্লাসে থাকলেও আড়াই ঘন্টা পাঠদান সময়কালে ওরাই হয়ে উঠছে নিজেদের শিক্ষক।

অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস’া, দূর্যোগ ঝুঁকি ও বিদ্যুত সুবিধা বঞ্চিত ধুলাসারের চরাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবার। গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার, বালুচরে ফষল ফলানো কিংবা প্রচন্ড রৌদ্র, বৃষ্টি উপেক্ষা করে শ্রম বিক্রিই এখনও অধিকাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জন। সমাজে পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীর বর্তমান প্রজন্ম প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষার্থী নুর মোহাম্মদ, আল অমিন, আরাবি ও আরিফা। চার থেকে ছয় বছর বয়সী এ শিশুরা এখনই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে।

শিক্ষার্থী আল অমিন জানায়,“ ছবি ও কার্টুন দেখে শেখা ছড়া,কবিতা তাদের মুকস’্য হয় সহজে। এক/দুইবার দেখলেই মনে থাকে। আর এখনতো বর্ণমালাও তারা আর ভোলে না।”

দেয়ালে দেয়ালে বর্ণমালা দেখিয়ে সহপাঠীদের শেখাচ্ছে সাড়ে পাঁচ বছরের ফাতিমা। তার স্পষ্ট উচ্চারণ ও আদুরে গলায় শেখানো এ শিক্ষা মনযোগ সহকারে শুনছে তারই বয়সী শিশু শিক্ষার্থীরা। ফাতিমার ভাষায়,“ আপায় ট্যাব এ আমাদের সব শেখায়। আমরা গল্প শুনি। কার্টুন দেখি। অংক করি। এ ট্যাব দেখেই তারা শিখেছে গান ও কবিতা।”

শুধু কি পড়া, আমরা এখানেই (শ্রেণি কক্ষে) খেলি ক্রিকেট, ফুটবল, বর্ণ শেখার খেলা। আমরা দড়ি লাফ, কানামাছি, খেলার ছলে ১,২ কিংবা এবিসিডি শিক্ষাও শিখি। এ কথা জানালো শিশু শিক্ষার্থী মাহিন। এ শ্রেণিতেই পড়ছে বাকপ্রতিবন্ধী নাঈম (৬)। মুখের ভাষায় সে পিছিয়ে থাকলেও খাতা-কলম কিংবা রং পেন্সিলে ছবি আঁকায় সে এগিয়ে। অন্য স্বাভাবিক শিশুদের সাথে দেয়ালে আঁকা ছবি ও শ্রেণি আপার ট্যাব এ অংকন শিক্ষা দেখে নাঈমও আয়ত্ব করে ফেলেছে বর্ণমালা শিক্ষা ও অংকন।

শিক্ষিকা সোনিয়া সুলতানা জানালেন, তিঁনি শুধু প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কিন’ আধুনিক শিক্ষার সাথে উপকূলের শিশু ও অভিভাবকরা এখনও পরিচিত নয়। তাই নিজ উদ্যেগে ক্রয় করা ট্যাব এ শিক্ষা কনটেন্ট তৈরি করে শিশুদের শেখাচ্ছেন। এতে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে উৎসাহী হচ্ছে এবং মনযোগ দিয়ে কার্টুনে ছড়া, কবিতা কিংবা গল্প দেখে দ্রুতই শিখছে।

একাধিক অভিভাবক বলেন,“ ঘরে কারেন্ট নাই। টিভি নাই। কথা বলার জন্য বাটন মোবাইল রয়েছে। কিন’ আমরা ল্যাহাপড়ার কি জানি। স্কুলে আপায় যেভাবে মোবাইল দিয়া (ট্যাব) শিখায় তাতে বাসায় পড়ানোও লাগে না। অরাই (শিশুরা) সারাদিন স্কুলের পড়া গুনগুন করে। ভোর হলেই স্কুলে যাওয়ার জন্য দৌড় দেয়। আর আগে তো স্কুলে পাঠানোই ছিল কস্টের কাজ। এই শিক্ষা (ডিজিটাল শিক্ষা) যদি আগে গ্রামের স্কুলে থাকতো তাহলে আর মানুষ বকলম( মূর্খ) থাকতো না।

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান জানান, “শিশুবান্ধব বিদ্যালয়” হিসেবে চরাঞ্চলের এই বিদ্যালয় উপজেলায় বেশ সুনাম রয়েছে। স্কুলটি পরিপাটি ও আধুনিকায়নের চেষ্টা করছেন শিক্ষক, অভিভাবক ও এলাকাবাসীদের আন্তরিকতায়। বর্তমানে চার শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। ডিজিটাল শিক্ষা পুরোদমে চালুর জন্য দ্রুত বিদ্যালয়ে প্রজেক্টর সরবরাহ করা হলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কনটেন্টের শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত করা সম্ভব। তাহলে গ্রাম ও শহুরে শিক্ষার ব্যবধান কমবে। অভিভাবকরাও আন্তরিক হবে। এতে আগামীতে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হারও কমবে।

কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনি লাল সিকদার জানান, ডিজিটাল শিক্ষা প্রতিটি বিদ্যালয়ে চালুর জন্যই ল্যাপটপ দেয়া হয়েছে যাতে শিক্ষকরা বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারেণ। কিন’ স্কুলগুলোতে কবে নাগাদ প্রজেক্টর সরবরাহ করতে পারবেন তা জানাতে পারেণ নি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here