Sebika Debnathসেবিকা দেবনাথ ::  মেলা কিংবা প্রচন্ড ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতি অনেকেরই আছে। বুড়া বয়সের কথা বলছি না। ছোট বেলার কথা বলছি। এমন স্মৃতি আমারও আছে। তবে ভাগ্য ভালো মাইকিং করে হারানো বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়নি। ভীষন দূরন্ত ছিলাম। তাই আমি যার সঙ্গী হতাম তাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হতো।

তখন আমরা নরসিংদীতে থাকি। আমি ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি। মা আর পাশের বাড়ির পুতুল দিদার সঙ্গে গিয়েছি বাউলের আখড়ার মেলায়। প্রচন্ড ভিড়। মা এমন শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে রেখেছিলো যে হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার জোগার। উপায় নেই। আমার জন্য ওটাই প্রয়োজন ছিলো। উসখুস করি কিন্তু নো ছাড়ন।

তবুও হাসি মুখে মায়ের সাথে ঘুরছি। যা দেখি তা-ই কিনতে ইচ্ছা করে। মা অবশ্য নিরাশ করেনি। এখনও মনে পড়ে মাটির হাড়ি-কুড়ি, ব্যাংক, টিনের নৌকা (যা কেরোসিন তেল দিয়ে জলে চালানো যেতো), প্রজাপতি (কাঠের লাঠির আগায় টিনের লাল রঙ্গের প্রজাপতি। তার নিচে দুইটা চাকা। ওটা মাটিতে চালানো যেতো), চুড়ি, পুতুল (মাটির ও রাবারের), কাঠের ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল, আলমিরা, ড্রেসিং টেবিল আরও যে কত কী। মুখও চলেছে সমান তালে। নিমকি-মুরালি-নারকেলি-হাওয়াই মিঠাই (ছোট গোল গোল), আচার, চিনি গোল্লা (ছোট মিষ্টির উপর চিনির প্রলেপ) বাদ নেই কোনটাই।

প্রচন্ড ভিড় ঠেলে আমরা এগুচ্ছি। এক সময় টের পেলাম ভিড়ের মধ্যে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। মা মা করে কাঁদছি। আশেপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেলো। ঠিক কতক্ষণ এভাবে কেঁদেছি জানি না। তখন মায়ের অবস্থা যে কী হয়েছিলো তা হয়তো কখনও বুঝবো না। একটা সময় দেখলাম দু’হাত দিয়ে ভিড় ঠেলে কে যেন আমার দিকে আসতে চাইছে। দেখলাম আমার বিপদতারিনী। মা’কে দেখে জড়িয়ে ধরলাম। আমার তখন কান্না বন্ধ হয়ে গেলা। আর মা কাঁদছে।

এবারের বাণিজ্য মেলায় দু’বার যাওয়া হয়েছে আমার। দু’দিনই শুনলাম মাইকে বাচ্চা হারিয়ে যাবার ঘোষণা। মেলার আয়োজকরা শান্ত গলায় বলেন, ‘….. নামের একটি ছেলে মেলায় এসে হারিয়ে গেছে। তার বয়স…..। তার পড়নে…….. (শার্ট-প্যান্টের বর্ণনা)। বাচ্চাটির গায়ের রং কালে/ শ্যামলা/ ফর্সা। আর হারিয়ে যাওয়া শিশুটির পরিবারের লোকজন হাউমাউ করে কেঁদে শিশুটিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সহৃদয় ব্যক্তিদের কাছে আকুল আবেদন জানান।

Sebika Debnath
এবারের বাণিজ্য মেলায় মা, আপন বোন ও মামত বোনের সাথে

গ্রামে বা মফস্বল শহরে হারিয়ে গেলে দুই-একটা চেনা মানুষের চোখে পড়তো। কিন্তু ঢাকা যে বড়ই আজব শহর। চারিদিকে মানুষ গিজগিজ করে। কিন্তু চেনা মানুষ নাই। কাঁদতে থাকা একটি শিশুকে আগলে ধরে থাকার মতো মানুষ নেই। সবাই নিজেরটা নিয়ে ব্যস্ত। এটাও সত্য যে পরিস্থিতির কারণেই আমাদের মধ্যে থাকা ভালো মানুষের গুণগুলো উবে যাচ্ছে। আমরা মনুষত্ব্য হারাচ্ছি। জানি না এদের মধ্যে সবাই তাদের সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন কি না। প্রার্থনা করি এই হারিয়ে যাওয়া যেন ক্ষণিকেরই হয়।

মেলায় গতকালও শুনলাম মাইকে হারানো বিজ্ঞপ্তির ঘোষণা। খবরটা শুনে কষ্ট হচ্ছিলো। একটু পরেই একজন নারী (সম্ভবত শিশুটির মা) হাউমাউ করে কেঁদে মাইকে বললেন, ‘যে আমার ছেলেকে এনে দেবেন তারে আমি সব কিছু দিয়া দিমু।’ কথাটা শুনে মনে আশঙ্কা উঁকি দিলো। দিনকাল তো ভালো না। শিশুটি যদি কোন ছেলেধরার হাতে পড়ে, তখন কী হবে? মোটা অংকের টাকা দাবি করে ছেলেটির যদি কোন ক্ষতি করে ফেলে? রাগ লাগলো ছেলেটির মায়ের উপর। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, বাচ্চা কেন সামলায়ে রাখে না। ঠিক হইছে।

কিন্তু তখনও আমি মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম ছেলেটি যেন তার মায়ের বুকে ফিরে আসে। আমার সঙ্গে থাকা এক বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘কী বলিস এসব? এভাবে বলা ঠিক না। যার হারাইছে সে-ই জানে।’ বন্ধুটিকে বলা হয়নি, ভিড়ে হারানোর স্মৃতি আমারও আছে। কষ্টটা আমিও বুঝি।

 

 

লেখক: সাংবাদিক, দৈনিক সংবাদ। ইমেইল: sebikadebnath@yahoo.com

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here