বিশ্ববাসীকে শোকের সাগরে ভায়িয়ে চলে গেলেন বর্ণবাদী বিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন মেন্ডেলা। ৯৫ বছরের বণাঢ্য জীবনে কি করেননি মেন্ডেলা? দেশবাসীর হৃদয়তো জয় করেছেনই, তামাম দুনীয়ার মানুষের কাছে প্রিয় হয়েই পৃথিবী ছেড়েছেন মেন্ডেলা। আর আমাদের নেতা-নেতৃরা কি করছেন? প্রশ্ন হলো ক্ষমতার জন্য কি করছেন না তাঁরা? দীর্ঘ সময়ের ফিরিস্তি দিতে চাই না। খাতা-কলম নষ্ট করাটাই বেহুদা। গত ১ মাসের কর্মকান্ডতেইতো আমাদেও রাজনৈতিক দলের নেতাদের দেশ প্রেমের নমুনা খুঁজে পাচ্ছেন দেশবাসী। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একপেশে ইচ্ছায় ন্যায়, সত্যে আজ পদদলীত। রিতিমত দেশে দেশপ্রেমর দুর্ভিড়্গ চলছে। বিরোধীদল নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে এক্কবারে অনড়। সরকারও নাছোড়বান্দা। বিরোধীদল আর সরকারি দল যে যার মত করে স্বার্থ উদ্ধারের লড়াই করে যাচ্ছে। হরতাল-অবরোধে দেশ অচল। যৌক্তিক বা অযৌক্তিক দাবীতে দেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালছে। মানুষ পুড়ে মরছে, সম্পদ ধ্বংশ হচ্ছে। সকাল সন্ধা ধাউ ধাউ ফট্‌ ফট্‌ শব্দে দেশবাসীর কান এক্কবারে ঝালাপালা। হাল সময়ে দেশের রাজনীতিতে যে চিত্র পরিলড়্গিত হচ্ছে তা অত্যনত্ম লজ্জার এবং ঘৃণ্য। বাংলাদেশ যেভাবে জ্বলছে তাতে সারা দুনিয়া উদ্বিগ্ন। দেশের ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো আজ অর্থনীতি বাঁচানোর তাগিদে মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দু’টি রাষ্ট্রের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বহু রাষ্ট্র সংকট সমাধানে আহব্বান জানিয়েছে। বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছে জাতিসংঘও। সব কিছুকে ব্যর্থ করে আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল চলছে তাদের ইচ্ছামাফিক। আর এমন চলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত দেশের মানুষের জীবন বলীদান হচ্ছে।

বর্ণবাদী বিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন মেন্ডেলার  অবর্তমানে শোকাহত আজ পুরো বিশ্ব। তিনি বিশ্ববাসীকে কাঁদাতে পেরেছেন এটাই তার সফলতা; এটাই একজন নেতার সফলত। এমন দেশপ্রেমী নেতাই চায় বিশ্ববাসী। এই অসাধারণ মানুষটির আত্নত্যাগ, নেতৃত্ব আমাদের শুধু মুগ্ধই করেনা, জীবনের অনেক ড়্গেত্রে প্রেরনাও জোগায়। এমন একটা ভালো লেকের চলে যাওয়া বুকের ভেতরটায় সত্যিই দুমড়ে মুচড়ে যায়। যখন আমাদের দেশের তথাকথিত নেতাদের কথা ভাবি; যখন ভাবি মেন্ডেলার দেশপ্রেম আর আমাদের নেতাদের ড়্গমতায় যাওয়ার লোভে মানুষ পোড়ানোর মানুষিকতা; আর মসনদ আকড়ে রাখতে মানুষকে কষ্ট দেয়ার খায়েশ কতই না তফাৎ। ভাবি ১৬ কোটি মানুষের মাঝে একজন মেন্ডেলা কি দেশে নেই? যে মেন্ডেলা বাংলাদেশকে আলোর পথ দেখাবে। শানিত্ম ফিরিয়ে আনবে দেশে। কবে সেই মেন্ডেলার জন্ম হবে; কবে বাংলাদেশ হবে শুদ্ধ, শোভিত সুনীল?

কোন পথে যাচ্ছে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি? এমন সহিংস দেশ দেখার জন্যই কি দেশের মানুষ জীবন বিসর্জন দিয়ে ছিলো? এমন অনিশ্চিত দেশ দেখতেই কি দেশের ৩০ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়ে ছিলো? আজ দেশের মানুষের কেন দিন কাটছে চরম আতংকে? অকাতরে অসহায় মানুষের জীবন ঝড়ে যাচ্ছে কেন? এতো রক্ত ঝড়ছে, মানুষ পুড়ে কাবাব হয়ে যাচ্ছে তবু ড়্গমতার লড়াই থামছে না কেন? হরদম চলছে গাড়ি পোড়ানো, রেললাইন তুলে ফেলা, রেলে আগুন জ্বালিয়ে রেল ধ্বংস করা, গাড়ি ভাংচুর করা, চলন্ত গাড়িতে গান পাউডার ও পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ মারার মতো চরম নাশকতা। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে এরা জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, নাশকতা করছে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সত্য ও ন্যায়ের বিকাশ না ঘটলে; রাজনীতিতে দেশপ্রেম না থাকলে দেশ, সমাজ ও সভ্যতায় কাক্সিড়্গত শানিত্ম আসতে পারে না। তাই দেশ জুড়ে কেবল অশানিত্মর দাবানল চলছে। আগুনে পুড়ছে দেশ। জানমাল নষ্ট হচ্ছে, অর্থনীতি পঙ্গু হচ্ছে; দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা কিছুতেই চলতে দেয়া যায় না। দেশের বিবেকবান মানুষকে এখন ন্যায় ও সত্যের পক্ষে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।

দেশের এমন চলমান রাজনৈতিক সংকটে সর্বত্রই একধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ সার্বিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে। কেবল এক দিনের হরতালে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ড়্গতি হয়। সে হিসাবে তিন দিনের হরতালে শুধু এ খাতেই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। হরতালের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ সব স্থবির হয়ে পড়ে। সময়মতো বিমান ও অন্যান্য পরিবহন চলাচল করতে পারে না বলে কোটি কোটি ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। সেই ড়্গতি ব্যক্তি পর্যায় ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। শেয়ারবাজারের মতো বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয় হরতালের কারণে। ঢাকা ও এর বাইরে থেকে কাঁচামাল এবং শাকসবজি আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকে ফলে কৃষক এবং সাধারণ মানুষ চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। হরতাল শিক্ষার্থীদের জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। হরতালের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকে, সেখানে শিক্ষার্থীদের যাওয়া-আসা করতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। হরতাল গণতান্ত্রিক কর্মসূচি হলেও এর গণতান্ত্রিক চরিত্র ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে। জ্বালা-পোড়াও, বোমাবাজি ও সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে হরতাল পালনে বাধ্য করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত রাখার নামে জনগণের পথচলা এবং নির্বিঘ্নে কাজ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির কাছে। যার অবসান হওয়া উচিত। হরতাল-সহিংসতার কারণে রোজগারি মানুষের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ধার করে, সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ-দুর্গতি বাড়ছে।রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল ও নৈরাজ্যের ফলে বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিশ্বের কাছে আমরা সহিংস জাতি হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছি। অন্ধ সমর্থক গোষ্ঠী দেশকে সহিংস রাজনীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ একটি অশান্ত জনপদ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে একটি ধারণা প্রচলিত আছে আর তা হলো- এ দেশের মানুষ পুরনো খারাপ ঘটনাগুলো দ্রুত ভুলে যায়। স্বরনশক্তি কম। এ কারণেই কোনো রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা এ দেশে দ্রুত ওঠানামা করতে পারে। একটিকে সরিয়ে আরেকটিকে মসনদে বসায়। ৪২ বছর ধরেই এমন ওলটপালট হচ্ছে দেশে। ঘুরে ফিরে একই চেহারা, একই জন। বড় আচানক জাতি আমরা। একটি মাত্র ঘটনা ভুলিয়ে দিতে পারে দীর্ঘ অপশাসনের স্মৃতি। যেই লাউ সেই কদু।

রাজনীতি যারা করেন তাদের মধ্যে যদি ইতিবাচক শিষ্টাচার থাকত, আমাদের দেশ আজ সংকটে খাদের কিনারে দাঁড়াত না। নিজেদের মধ্যে যদি ঐক্য, ভালোবাসা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকত তবে এত রক্ত ঝড়তো না, লাশ পড়তো না; পুড়তো না গাড়িও। রাজনীতির মাঠ দখল আর ক্ষমতা ধরে রাখার খেলায় সহিংসতার বলি হতো না পরিবহন খাত। আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধান রসদ হিসেবে কথায়-কথায় ‘ভাঙ গাড়ি,’ ‘দে আগুন’ নির্দেশ আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারণী মহল থেকে। আর সেই নির্দেশে গাড়ি ভেঙে-চুরে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সরগরম করা হচ্ছে রাজনীতির মাঠ। ছড়ানো হচ্ছে আতঙ্ক। কোনও-কোনও ঘটনায় শুধু গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না সহিংস রাজনীতি। প্রাণও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশে দলতন্ত্র চলছে। দলতন্ত্রে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভালো-মন্দ সবই সমান। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোন বিবেক সম্পন্ন শিক্ষিত ব্যক্তিও কোন দলের অন্তর্ভূক্ত হলে নিজের সত্তাকে বিকিয়ে দিতে হয়। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দোষে দুষ্ট হয় সে। এ দেশীয় দলতন্ত্রে মনুষত্ব আর বিবেক-বুদ্ধি লোভ পায়। দেশের কোন মানুষ যখন কোন একটা দলের ছত্রছায়ায় আসে তখন তার বিবেক-বুদ্ধি দলের মধ্যে নিমজ্জিত হয়। এ ভাবে দেশের মানুষ দলতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে পরেছে। অসহায় হয়েই মানুষ শান্তির আশায় একবার এ দল তো অন্য বার ওদলে ছুটছে।

কোথাও শান্তি মিলছে না। অন্যায় অত্যাচার  অতীষ্ঠ হয়ে জনগণ ৫ বছর পর পর শান্তি খোঁজে ঠিকই কিন্তু তারা শান্তির দেখা পায় না। অতীত অত্যাচারের কথা ভুলে যায়। এক দল ছেড়ে আরেক দলকে ভালো বেসে ক্ষমতায় আনে। মুদ্রার এপিট ওপিট যে সমান তা তারা পরে বুঝতে পারে। আসলে দেশের জনগণ আছে জ্বলন্ত উনুন কিংবা ফুটন্ত কড়াইয়ে। একবার তারা লাফিয়ে পরে ফুটন্ত কড়াইয়ে আবার বাঁচার লড়্গে লাফ দেয় জ্বলন্ত উনুনে ।

এভাবেই ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে লাফালাফি করতে থাকে জনগন। তাতেও নিস্তার নেই। অশান্তির দাবানল থেকে মুক্তি নেই। এ ব্যবস্থার নামই দলতন্ত্র। দেশ বাঁচাতে হলে আগে এই দলতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে হবে। দেশে প্রকৃত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে জনগন শান্তি ফিরে পাবে। জনগনের চাওয়া পাওয়া সমবসময় প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগনের দ্বারা, জনগনের জন্য পরিচালিত হবে দেশ।

মীর আব্দুল আলীম
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here