কুয়াকাটামিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী)প্রতিনিধি :: বিশাল সমুদ্রের নীল জলরাশি দোলনার মতো যখন দুলে দুলে তীরে আসতে থাকে তখন পূর্ব আকাশে সূর্যের হালকা রক্তিম বৃত্তটা ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। তখন প্রথম সূর্যোদয়ের আলোতে আলোতিক হয়ে পাল্টে যায় কুয়াকাটার সমুদ্রের নীলাভ জল বর্ন। লাল বর্ণ সূর্যটা অল্পক্ষণের মধ্যেই পূর্ণ বৃত্তে রূপ নেয়। এই নতুন সূর্য পুব আকাশে নিয়ে আসে এক অপরূপ শোভা। আকাশের ক্যানভাসে সদ্য ওঠা সূর্য, নিচে সমুদ্রের নীল জল, সুদীর্ঘ বেলাভূমি আর পাশে ঘন সবুজ ঝাউবনের সমন্বয়ে কুয়াকাটা সৈকত ফিরে পায় অপরূপ সৌন্দর্য। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সৈকতের ভোরের সর্যোদয়ের বাস্তব রুপচিত্রের এ বর্ননা। যা শুধু কল্পনার ক্যানভাসেই আঁকা যায়।

বেলা গড়িয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য কুয়াকাটা সৈকতের আরেক সৌন্দর্য নিয়ে আসে। গোধূলিতে পাখির কিচির-মিচির শব্দ সূর্যাস্তের দৃশ্যটা আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার একেবারে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর কূলের নিরিবিলি একটি স্থান সাগরকন্যা কুয়াকাটা। যার খ্যাতি এখন দেশ থেকে বিদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। জেলা শহর থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার। সৈকত থেকে উত্তরে এককালীন রাখাইন অধ্যুষিত জনপদ, দক্ষিণে অন্তহীন সমুদ্র, পূর্বে গঙ্গামতি সংরক্ষিত অরণ্যাঞ্চল ও পশ্চিমে খাজুরার বনাঞ্চল। এই সীমা পরিবেশিষ্টত কুয়াকাটা চিত্তকর্ষক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।

যেখানে দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সৈকতের যেকোন স্থানে দাড়িয়ে উপভোগ করা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। কুয়াকাটায় রয়েছে আদিবাসী ও রাখাইন সম্প্রদায়ের নিজস্ব কুটিরশিল্প ও দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ দর্শনের বিচিত্র আকর্ষণ। মূলতঃ এসব কারণেই প্রতিবছর দেশ-বিদেশের অগণিত পর্যটকের আগমন ঘটে কুয়াকাটায়।

কুয়াকাটানামকরণ: স্থানবিশেষে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের প্রস্থ ৩ থেকে সাড়ে ৩ কিলোমিটার। কুয়াকাটা নামকরণের ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যাবে সেই দূর অতীতে (১৭৮৪) তৎকালীন বর্মী রাজা ‘‘বোদোপায়া’’ রাখাইনদের আবাসভূমি ‘‘আরকান’’ (প্রাচীন রাখাইন-প্রে) দখলে ও তাদেরকে নির্মমভাবে নিধন শুরু করলে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বহু রাখাইন মাতৃভূমি ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়ে ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এদের একাংশ নৌকা যোগে সোজা পশ্চিম দিকে তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ উত্তাল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে প্রথমে এসে অবতরণ করে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার অন্তর্গত রাঙ্গাবালি (বর্তমান রাঙ্গাবালী উপজেলা) নামক দ্বীপে।

পরে তাদের বড় অংশ কলাপাড়া উপজেলার বালিয়াতলী ও লতাচাপলী ইউনিয়নের কুয়াকাটা, কেরানিপাড়া, গোরা আমখোলা পাড়া, কালাচানপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে এসে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। সমুদ্রের তীরে বসতি স্থাপন করলেও পানি লোনা থাকায় এদের ছিল না সুপেয় পানির ব্যবস্থা। সুপেয় পানি পাওয়ার আশায় তারা প্রথমে এখানে দু’টি অগভীর কুপ খনন করে। আর এ কুপ খনন বা স্থানীয় ভাষায় ‘কুয়া’ কাটা থেকে স্থানটির নাম হয় ‘কুয়াকাটা’। যা এখন বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃত।

যোগাযোগ: রাজধানী ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে কুয়াকাটায় আগমনের রয়েছে একাধিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঢাকা থেকে বাস অথবা বিমানে বরিশাল, সড়ক পথে ঢাকা থেকে সরাসরি কলাপাড়া কিংবা কুয়াকাটায় আসার সুযোগ রয়েছে। সড়ক ও লঞ্চপথে পটুয়াখালী হাইওয়ে দিয়ে প্রথমে কলাপাড়া (খেপুপাড়াও বলা হয়) উপজেলা সদর থেকে সোজা সড়ক পথে কুয়াকাটা। আগে কলাপাড়া থেকে তিনটি ফেরি থাকলেও এখন আন্ধারমানিক, সোনাতলা ও আলীপুর নদীতে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতু নির্মান হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোন ঝামেলা পোহাতে হয়না।

কুয়াকাটারাখাইন পল্লী: ইতিহাসের ঠিক কোন সময়ে কুয়াকাটায় মানববসতি গড়ে উঠেছিল তা আজ আর নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে ১৭৮৪ সালের পর থেকে এখানে গহীন বন-জঙ্গলে রাখাইন জনগোষ্ঠীর বসবাস শুরু হয় বলে পটুয়াখালী জেলা গেজেটিয়ার বই থেকে স্বচ্ছ্ব ধারনা পাওয়া যায়। কুয়াকাটা ও কলাপাড়া আদি বাসিন্দা যে রাখাইন সম্প্রদায় তা সর্ববাদিসম্মত।

এককালে এ অঞ্চলে রাখাইনদের (‘রাখাইন্থ বা রখইঙ্গ, শব্দবদ্ধ সংস্কৃত ‘রক্ষ’ ও পালি ‘সখ্খো’ থেকে গৃহীত, যার অর্থ দৈত্য বা রাক্ষস) একচ্ছত্রাধিপত্য থাকলেও আজ তারা সংখ্যালঘুই শুধু নয়, বরং তাদের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্ত্বার ঘটেছে ক্রমবিলুপ্ত। তথাপি তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি ধরে রেখেছে এই রাখাইন পল্লীকে ঘিরে। এখানে গেলে খুব কাছ থেকে তাদের দৈনন্দিন জীবনাচার ও কার্যকলাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়।

KUAKATAসীমা বৌদ্ধমন্দির: সমুদ্র সৈকতের কাছে কেরানিপাড়ায় এটি অবস্থিত। ঠিক করে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে মন্দিরটি যে বেশ প্রাচীন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মন্দিরের ভিতরে প্রায় ৩ ফুট উচু বেদীর উপর সংস্থাপিত সাড়ে ৩৭ মন ওজনের অষ্টধাতুর নির্মিত একটি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। জনৈক প্রয়াত বৌদ্ধভিক্ষু উপেংইয়া মূর্তিটি স্থাপন করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কাঠ ও টিনের তৈরী সুদৃশ্য মন্দিরটির নির্মাণশৈলী ইন্দোচিনের অনুকরণ নির্মিত। সর্বশেষ বৌদ্ধ মূর্তিটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। পুরণো নির্মাণশৈলী আর স্থাপত্যিক সৌন্দর্য বজায় রেখে টিনসেট ঘরটির পাশেই নির্মণ করা হয়েছে পাকা মন্দির ভবন।

কুয়াকাটাঅতিপ্রাচীন কুয়া (কূপ): ‘কুয়াকাটা’ নামকরণ, যে ‘কুয়া’ বা কূপ খননের কারণে এটি তার একটি। সৈকত থেকে খুব কাছেই এর অবস্থান। সীমা বৌদ্ধমন্দির সংলগ্ন । পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়।

নারিকেল কুঞ্জ বা বীথি ও ঝাউবন: সমুদ্র সৈকতের একেবাবে কোল ঘেঁষে প্রায় ২০০ একর জায়গায় ষাটের দশকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল এই নারিকেল কুঞ্জ । তবে সমুদ্রের অব্যাহত ভাঙ্গনে ইতিমধ্যে এর অর্ধেকটাই বিলীন হয়েছে। নারিকেল কুঞ্জের পাশেই (পূর্বদিকে) পটুয়াখালী বনবিভাগ কর্তৃক ১৫ হেক্টর বালুভূমিতে তৈরী হয়েছে ঝাউবন।

বলা বহুল্য মানবসৃষ্ট হলেও গোধুলী বেলায় সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে ও বিশেষ করে পূর্ণ চন্দ্রালোকিত জ্যোৎস্না স্নাত রাতে যখন বেলাভূমি থেকে নারিকেল বীথি ও ঝাউ বাগানের দিকে দৃষ্টি নিপতিত করা হয় তখন বেরসিক দর্শনার্থীর কাছেও তা একঅমলিন স্বর্গীয় আবেদনের সৃষ্টি করে। আর দিনে ঝাউবনের ভিতর দিয়ে যখন সমুদ্রের নির্মল লোনা বাতাস বয়ে যায় তখন বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ এক নিরবিচ্ছিন্ন ঐক্যতান সৃষ্টি করে শ্রোতার কানে, আনে অনির্বাচনীয় মাদকতা।

ফাতরার চর: সমুদ্র সৈকতের বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি ছেড়ে পশ্চিম দিকে গেলে পাওয়া যাবে ঘোলা জলের একটি ছোট্ট স্রোতস্বিনী নদী ও বীচিমালাবিক্ষুব্ধ সাগর মোহনার কাছে ‘ফাতরার চর’ নামক সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বন। যার আয়তন প্রায় দশ হাজার একর। লোকমুখে ইতিমধ্যেই এটি ‘দ্বিতীয় সুন্দরবন’ হিসেবে পরিচিতি ও খ্যাতি পেতে শুরু করেছে। কেওয়া, গেওয়া, সুন্দরী, বাইন, ফাকড়া, গড়ান, গোলপাতা প্রভৃতি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং বানর, শুকরসহ অসংখ্য জীবজন্তু ও পাখপাখালি সমৃদ্ধ এ অরণ্যাঞ্চল। এছাড়া শীতকালে ঝাঁকে ঝাঁকে এখানে আবির্ভাব ঘটে অসংখ্য অতিথি পাখির।

গঙ্গামতির চর: কুয়াকাটার মূল ভূখন্ডের পূর্বদিকে আনুমানিক ১০ কিলোমিটর দূরে অবস্থিত ‘গঙ্গামতির চর’ পর্যটক আকর্ষণের আরেকটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর দর্শনীয় স্থান। স্বচ্ছ নীল জলাধার (খাল), যার এক তীরে ক্রমশ ঢালু হয়ে সাগরের বুকে নেমে যাওয়া ভাঁজপড়া বালিয়াড়ি আর অন্য তীরে রয়েছে সমতলভূমি। সামনেই পেরিয়ে বিস্তীর্ণ বন। এখানে কেওড়া, গেওয়া, ছইলা, খৈয়া ইত্যাদি হরেক রকমের গাছগাছালি ছাড়াও আছে বুনো শুয়োর, বন মোরগ আর পাখির কিচির মিচির শব্দ। তবে ৮০’র দশকের পরও এই বনাঞ্চল জুরে ছিল বানর ও শুকরের আস্তানা। এই বনে প্রবেশ করলে শরীর ছম ছম করত।

কুয়াকাটারাসমেলা: মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের ভগবান শ্রী কৃষ্ণের লীলাকে ‘রাস’ মেলা কথাটি এসেছে মূলত ‘রস’ শব্দ থেকে। শীতকালে রস আহরণকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল এ উৎসবের জয়যাত্রা। পরবর্তীকালে এর নাম হয় ‘রাসমেলা বা রাস উৎসব’। হিন্দু সম্প্রদায়ের রাসমেলা কুয়াকাটার একটি প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব পালন করতে শুরু হয়।

কুয়াকাটায়ও যথাযোগ্য মর্যাদা ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় ৩ দিনব্যাপী রাসমেলা পালিত হয়ে আসছে। এজন্য মেলার শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। বলা যায় তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না তখন। তৃতীয় দিনে খুব প্রত্যুষে সাগরের প্রথম জোয়ারে পূণ্যার্থী নরনারী সমুদ্র স্নানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই মেলা বা উৎসব।

লেম্বুর চর: কুয়াকাটা সৈকত থেকে পশ্চিম দিকে ৫ কিলোমিটার দূরের একটি মনোরম স্থান লেম্বুর চর। এখানে রয়েছে প্রায় ১০০০ একর বিশিষ্ট কেওড়া, কড়াই, গেওয়া, ছৈলা ইত্যাদির বন।

শুঁটকি পল্লী: কুয়াকাটা থেকে পশ্চিমে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কুয়াকাটা শুঁটকি পল্লী। শীতকালে জেলেরা সাগর বক্ষ থেকে যে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট বড় সামুদ্রিক মাছ ধরে ও আহরণ করে সেটিই এখানে শুঁকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। যারা শুটকি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ দেখেনি, তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এটি একটি শিক্ষণীয় স্থান হতে পারে। এখান থেকে শুটকি মাছের চালান যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম।

কুয়াকাটা আদর্শ গ্রাম: কুয়াকাটা লতাচাপলী মৌজার সমুদ্র সৈকতের লাগেয়া ৫ একর জমির ওপর ১৯৯৮-৯৯ অর্থ বছরে ‘কুয়াকাটা আদর্শ গ্রাম’ স্থাপিত। এখানে পুনর্বাসিত পরিবারের সংখ্যা ৫০টি। পুনর্বাসিতদের অধিকাংশেরই পেশা/জীবিকা মূলতঃ সামুদ্রিক মৎস্য শিকার।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here