pijush-2গ্যালিলিও গ্যালিলি হয়ে আর তিনি বলবেন না, ‘দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে শুধু বীরেরই প্রয়োজন হয়৷’ টেলিভিশনের পরদায় মানসিক ভারসাম্যহীন স্ত্রীকে আর আগলে আগলে রাখবেন না তিনি৷ আর কোনও বৈঠকি আড্ডায় উদারগলায় গেয়ে উঠবেন না গান৷ দশমী পেরিয়ে আরও একবার পুজো আসবে আগামী বছরে৷ কিন্তু আর ফিরবেন না পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়৷ দুর্ঘটনার কালো ছায়া তাঁকে টেনে নিল অকালমৃত্যুর পথে৷ শহরের এক নার্সিংহোমে ৫৪ বছর বয়সে যবনিকা পড়ল তাঁর জীবন নাটকে৷
‘অভিনয়কে ভালবেসে ব্যাংকের চাকরিটা তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ যে মানুষ স্বপ্ন দেখে, যে মানুষ গান করে, যিনি রক্ত দিয়ে ভালোবাসেন অভিনয়, তিনি কী করে বাঁধা থাকবেন চাকরির চেনা গণ্ডিতে৷ থাকেনওনি৷ ছাপোসা জীবনের নিশ্চিন্তিকে বিদায় দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন অভিনেতা জীবনকে৷ মঞ্চের আলোআঁধারিতে সেই জীবনকে মূর্ত করে তোলার জীবনই যাপন করে চললেন আজীবন৷ থিয়েটারের শক্তিমান এই অভিনেতা কাজ করেছেন বাংলা নাটকের বহু বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে৷ বিভাস চক্রবর্তী থেকে ব্রাত্য বসু- বিভিন্ন সময়ে নাট্য পরিচালকদের সহায় হয়েছে তাঁর কুশলী অভিনয় প্রতিভা৷ ‘মাধব মালঞ্চ কইন্যা’, ‘জোছনা কুমারী’, ‘আকরিক’, ‘জ্যেষ্ঠ পুত্র’ থেকে ‘ব্রেন’, ‘সিনেমার মতো’ বাংলা নাট্যদুনিয়ার সেরা নাটকগুলিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি৷ ‘গ্যালিলিও গ্যালিলি’ নাটকে গ্যালিলিওকে নতুন করে রূপও দিয়েছিলেন৷ শম্ভু মিত্র, কুমার রায়ের মতো তাবড় অভিনেতারা বাংলার মঞ্চে যে চরিত্রের রূপদান করেছেন, সেটিকেই একেবারে নতুন করে উপস্থাপন করেছিলেন স্বকীয় মেজাজে৷ গ্যালিলিওর দ্বন্দ্ব, শিল্প ও সত্তার সংঘাতের সঙ্গে কী অনবদ্য অভিনয় দক্ষতায় তিনি মিশিয়ে দিয়েছিলেন একজন সাধারণ চেনা মানুষকে মানসিক টানাপোড়েনের বাস্তবোচিত ব্যবহারগুলিকে৷ ফলত এ গ্যালিলিও গা চুলকোয়, দাঁত খোঁটে৷ এমনকী খেয়েদেয়ে ঢেঁকুরও তোলে৷ কোথাও কোনও আরোপ নেই৷ বিস্ময়াবিষ্ট দর্শক শুধু দেখেছেন, সাধারণের এই সাজে কীভাবে প্রতি পলে অসাধারণ হয়ে উঠতেন পীযূষ৷ সে অভিনয় বন্ধ হয়েগেল চিরকালের জন্য৷ আবারও পড়বে থার্ড বেল, উঠবে মঞ্চের পর্দা, পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় আর কোনওদিন এসে দাঁড়াবেন না সেন্টার স্টেজে৷
বাংলা সিনেমা ও টেলিভিশনের দুনিয়াতেও তিনি ছিলেন অত্য্যন্ত জনপ্রিয় মুখ৷ বাংলা টেলিসিরিয়ালের আদিপর্ব থেকেই তিনি ছিলেন এই মাধ্যমে সক্রিয়৷ ‘জন্মভূমি’, ‘সোনার হরিণ’-এর মতো সিরিয়াল থেকে ফিলহাল ‘জলনুপূর’ বা ‘চোখের তারা তুই’ সিরিয়ালেও কাজ করেছেন তিনি৷ পাশাপাশি কাজ করে গিয়েছেন বাংলা ছবিতেও৷ চিদানন্দ দাশগুপ্তর ‘আমোদীনি’ থেকে অপর্ণা সেনের ‘গয়নার বাক্স’, অঞ্জন দত্তর ‘ম্যাডলি বাঙালি’ থেকে সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়ের ‘অটোগ্রাফ’- স্ক্রিনে পীযূষ গঙ্গোপাধ্যয় আসা মানেই কী অনায়াসে এক একটি চরিত্র হয়ে ওঠা৷ নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখেই হরেক চরিত্রাভিনয়ের এরকম এক দক্ষ অভিনেতাকে আর পাবে না বাংলা সিনেমার দুনিয়া৷ এমনকী অসংখ্য টেলিফিল্মে তিনি যে অভিনয় রেখে গেলেন তাও আগামী প্রজন্মের কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে৷ গানও গাইতে পারতেন চমৎকার৷ টেলিভিশনের পরদাতেই অ্যান্টনি কবিয়ালের ভূমিকায় অভিনয় করে, গেয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন দর্শকদের৷ নাটকে যেমন গাইতেন, তেমন প্লে-ব্যাকও করেছেন৷ রেকর্ডে ধরা থাকল সে সব৷ আর কখনও ‘লাইভ’ হবেন না পীযূষ৷
সপ্তমীর বিকেলে সাঁতরাগাছি ব্রিজের উপর বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় তাঁর গাড়ির৷ তাঁকে ভর্তি করা হয় বেলভিউ নার্সিংহোমে৷ একই গাড়িতে ছিলেন নৃত্যশিল্পী মালবিকা সেন৷ তিনিও গুরুতর জখম হন৷ প্ল্যাস্টিক সার্জারির পর তিনি আপাতত সুস্থ৷ ধাপে ধাপে বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচার হয় পীযূষবাবুরও৷ কিন্তু ক্রমশ তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে৷ ভেন্টিলেশনে রাখা হয় তাঁকে৷ কিন্তু শেষমেশ চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল৷ আর ঘরে ফেরা হল না তাঁর৷
হয়ত ফুটবল খেলেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন স্কুলজীবনের তুখোড় গোলকিপার পীযূষ৷বেহালা ইয়ুথে খেলেছেন তিনি৷ পারতেন চাকরির নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে জীবন কাটিয়ে দিতে৷ কিন্তু তিনি তো ভালবাসতেন অভিনয়৷ ভালবাসতেন নাট্যমুহূর্তে মঞ্চে মূর্ত হয়ে ওঠা জীবন৷ যে জীবন ক্ষণিকের, তবু অনন্ত তৃপ্তির৷ যে জীবন থাকে না, স্মৃতি আর শ্রুতি ছাড়া যে জীবনের অস্তিত্ব নেই, তবু যেন কোন জাদুবলে তা বেঁচে থাকে৷ সে জীবনকে গড়ে তোলা যেমন সাধনার, ফুরিয়ে যাওয়া তেমনই আকস্মিক৷ নিজের জীবনের আসা-যাওয়াতেও থেকে গেল যেন সেই আকস্মিকের খেলা৷তবে এবারের মঞ্চ তো আসল জীবনের৷ এবারের প্রস্থান আছে, আর ফেরা নেই৷ জীবনের নাটক ছেড়ে শেষবার বেরিয়ে গেলেন পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়৷ বিষাদ ভারাক্রান্ত বাঙালি দর্শক শুধু জানে, এ নাটকের আর কোনও দ্বিতীয় শো নেই৷

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here