অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়:: পশ্চিমবঙ্গের শিশু কিশোর আন্দোলনের প্রেক্ষাপট শতবর্ষের বেশি। সূচনাটা হয়েছিল ব্রিটিশদের আগ্রহে, স্কাউটের হাত ধরে। তখনকার সেই শুরু হওয়াটাকে আন্দোলন বলা যাবে কিনা, এই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। তবু আলোচনায় অবিভক্ত বাংলাতে শিশুকিশোরদের সংগঠন হিসাবে স্কাউটের ভূমিকা অনুল্লেখ করা অন্যায় হবে।

গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের ও সংঘ প্রতিষ্ঠাকে আমি শিশুকিশোর আন্দোলন বলতে রাজী নই। শিশুকিশোর আন্দোলন বলতে গেলে বিভিন্ন সংবাদপত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরী হওয়া মনিমেলা, মুকুলের মাহফিল, কিশোর বাহিনী, সব পেয়েছির আসর পরাধীন সময়ের শিশুকিশোর সংগঠন। যারা মূলতঃ শিশুকিশোরদের নিয়েই ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রসারের কাজ করে। মুকুলের মাহফিল ছাড়া অন্যান্য শিশুকিশোর সংগঠন এখনো কাজ করছে। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, বাংলাদেশের শিশুকিশোর সংগঠনগুলোর আলোচনা এখানে করছি না।

ব্যক্তিগত জীবনে ছেলেবেলাটা কেটেছিল শিশুকিশোর সংগঠনে। পরে কর্মসূত্র আমার সাথে শিশুকিশোর সংগঠনের বিচ্ছেদ ঘটায়। অবসর জীবনে এখন সেই ছেলেবেলার কর্মচঞ্চল দিনগুলির রোমন্থন করি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মনিমেলা ও সব পেয়েছির আসরের ধারাবাহিকতা কখনো ক্ষুন্ন হয়নি। তবে কিশোর বাহিনী মাঝে দিয়ে আড়াই দশক কেন্দ্রীয়ভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি।

এইসব শিশুকিশোর সংগঠন ছাড়াও জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘ, সারা বাংলা শিশু সংস্থা, বাংলার ব্রতচারী সমিতি, ব্রতচারী কেন্দ্রীয় নায়কমন্ডলীও এখন পশ্চিমবঙ্গে শিশুকিশোরদের নিয়ে কাজ করছে। প্রযুক্তির কল্যানে এইসব সংগঠনের নানাবিধ কর্মসূচীর ছবি, খবরাখবর দেখে আনন্দ পাই। এটুকু বুঝি, এখনো কিছু মানুষ আছে, যারা শিশুকিশোরদের সংগঠিত করার বিষয় নিয়ে ভাবেন। স্কাউটের আলোচনা এই নিবন্ধে করছি না।

যারা এইসব সংগঠনের সাথে যুক্ত, তাদের সাথে আলাপপরিচয় ও তাদের পত্রপত্রিকা ঘেঁটে আমার মনে হয়েছে, বর্তমান সময়ে এইসব শিশুকিশোর সংগঠনের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আর্থিক সমস্যা, উপযুক্ত জায়গার সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা এদের কাজে প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া সামাজিক পরিস্থিতিও এইসব সংগঠনের কাজ করার অনুকুল নয়। তাঁর মধ্যেই যারা কাজ করছেন, তারা অদম্য জেদ এবং তাগিদ থেকেই করেন বলেই আমার বিশ্বাস। সব পেয়েছির আসর ও কিশোর বাহিনীর অবস্থাটা তুলনামূলক ভাল।

সারা রাজ্যে সব পেয়েছির আসরের শাখা শ’দুয়েক আছে, এবং অন্ততঃ শ’খানেক শাখা সক্রিয়তার সাথেই কাজ করে। কিশোর বাহিনীর শাখার সংখ্যা বেশি। তাদেরও সক্রিয়তাও তদ্রুপ। মনিমেলাতে ইদানীং কিছুটা ভাটার টান লক্ষ করছি। সারা বাংলা শিশু সংস্থাও তদ্রুপ। জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘের শাখার সংখ্যা খুবই হতাশাজনক। বাংলার ব্রতচারী সমিতি ও ব্রতচারী কেন্দ্রীয় নায়কমন্ডলীর সেই অর্থে শাখা নেই। তবে সারা রাজ্যে তাদের কিছু সংগঠক আছেন, তাদের কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্কুল, সংস্থায় তারা প্রশিক্ষন দেন।

তথ্যে কিছু অসংগতি থাকতে পারে। কারন তথ্যগুলি তাদের সংগঠকদের কাছ থেকে পাওয়া। সাহায্য নিয়েছি গত দুই বছরে তাদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকার। ফলে অসংগতি থাকাটাও অসম্ভব নয়। সংগঠনের অবস্থা যাই হোক, প্রকাশ্যে সাধারনতঃ কেউ তা স্বীকার করে না।

কিন্তু এইসব সংগঠনগুলোর প্রসার এই সময়ে খুব দরকার। এই সময় কেন, সব সময়েই দরকার। দরকার সরকারী সাহায্য। কিন্তু তারা পান না। একেবারেই পান না, একথা বলা অন্যায় হবে। রাজনৈতিক পরিচয়, যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে কোন কোন শাখা বা ব্যক্তি কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে পারলেও, বেশিরভাগ শাখাই সরকারী অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত। তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো উচিৎ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের।

যে কোন শিশুকিশোর সংগঠনের লক্ষই হল, ছোটদের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রসারে কাজ করা। পশ্চিমবঙ্গের সংগঠনগুলো সেই কাজ ঠিকভাবেই করছে তাদের সাধ্যের মধ্যে। যে খামতি তাদের আছে, তার জন্য তারা দায়ী নয়, দায়ী সরকার, দায়ী সমাজ, দায়ী আমরা। যে কাজ করার কথা সরকারের, সেই কাজে ব্রতী হয়েছে এরা। বিনা স্বার্থ তারা পকেটের পয়সা, শ্রম দিয়ে কাজ করে। সমাজ দেখে না, আমরা দেখি না। নিজেরা কোন উদ্যোগ নিই না এদের পাশে দাঁড়াতে।

যে স্বপ্ন নিয়ে স্বপনবুড়ো, কবি সুকান্ত, বিমল ঘোষেরা এইসব শুরু করেছিলেন, তাকে রক্ষা করতে কি ভূমিকা সরকারের, সমাজের, আমাদের? এর উত্তর আমার কাছে নেই।

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here