জহিরুল ইসলাম শিবলু, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি :: মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার গৌরবময় রক্তাক্ত সংগামের সাথে মহান একুশে ফেব্রুয়ারী ও শহীদ মিনার মিশে আছে আমাদের বাঙ্গালী জাতির চেতনা ও হৃদয়ের গভীরে। ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলন। আর এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই পরবর্তীতে বাঙ্গালী জাতী স্বাধীনতা অর্জনের দীক্ষা লাভ করেন।
আমাদের ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার বাঙ্গালী জাতীয় জীবনের সকল চেতনা ও অনুপ্রেরনার উৎস। বাঙ্গালীর চেতনার অন্যতম একটি দিন ২১ ফেব্রুয়ারী। একদিকে দুঃখের, অন্যদিকে সুখের। যা বরাবরই আমাদের রক্তে বাজায় অস্থিরতার সুর।
যা তলিয়ে যাবার নয়। কারন, স্মৃতির মিনার আমাদের হৃদয়ে, শহীদ মিনার আমাদের সামনে। যা কোন দিন বিস্মৃতি হবার নয়। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কী ভূলিতে পারি, স্মরনীয় এ গানটি যখন এদেশের ছাত্র জনতার মুখে ব্যাপকভাবে ধ্বনিত হয়নি-তখন শহীদ মিনার স্থাপন করা ছিল দুঃসাহসিক বিষয়।
আইয়ুব শাসক গৌষ্ঠির রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে সে সময় লক্ষ্মীপুর জেলার কয়েকজন কলেজ ছাত্র ও তরুন মিলে তৎকালীন কিছু আওয়ামীলীগ নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় ইট বালি দিয়ে লক্ষ্মীপুর সরকারী কলেজ প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপন করেন ১৯৬৯ সালে। কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পেয়ে রাতের আঁধারে নির্মাণ করেন শহীদ মিনার।
দেশ তখন বঙ্গবন্ধুর ১১দফার আন্দোলনে উত্তাল আর ঠিক সে সময় কিছু প্রতিবাদী ছাত্র-তরুণ ভাষা শহীদদের স্মরনে কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পেয়েও রাতের আধারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধায় অনুপ্রাণিত হয়ে শহীদ মিনার তৈরী করেন। শহীদ মিনার তৈরীতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তৎকালীণ ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে পৌর শহীদ স্মৃতি একাডেমীর প্রধান শিক্ষক হোসেন হায়দার ভূঁঞা, লক্ষ্মীপুর মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মনছুরুল হক, প্রায়াত সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার মাষ্টার আনোয়ারুল হক, প্রায়াত জাসদ নেতা সালাউদ্দিন ভূঁঞা ও নিজাম উদ্দিনসহ ২০/২৫ জন। এছাড়াও তাদের সহযোগিতা করেন লক্ষ্মীপুর সরকারী কলেজের তৎকালের শতাধিক ছাত্র।
লক্ষ্মীপুরের প্রথম শহীদ মিনার স্থাপনের অন্যতম উদ্যোক্তা বর্তমান পৌর শহীদ স্মৃতি একাডেমীর প্রধান শিক্ষক হোসেন হায়দর ভূঁঞা স্মৃতিচারণ করে বলেন, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণের জন্য বা শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এর আগে কোন স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদ মিনার এ জেলায় স্থাপন করা হয়নি। ১৯৬৯ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে দেশের মানুষ হাটিহাটি পা পা করে এগিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধুর ১১ দফার আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ঠিক তখনি আমরা ভাষা শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহন করি।
এই উদ্যোগের কথা তৎকালীণ আওয়ামীলীগ নেতা লক্ষ্মীপুর জেলার রূপকার এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর নছির আহম্মদ ভূঁঞা, এডভোকেট আক্তারুজ্জামান, এডভোকেট আহমদ উল্যা, ডা. আবুল বাসারসহ অন্যান্য নেতাদের জানাই। তাঁরা সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
কিন্তু বাদ সাধে তৎকালীণ কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল জব্বার। কলেজ প্রাঙ্গণে একটি শহীদ মিনার স্থাপনের অনুমতি চাইলে তিনি কড়া ভাষায় নিষেধ করেন। তার নিষেধ উপেক্ষা করে আমরা উদ্যোক্তারা সবাই রাতের আঁধারে কলেজ প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকি। রাত ১১টার পরে ডা. আবুল বাসারের বাসা থেকে ইট আনা হয়। কলেজের শতাধিক ছাত্র সে বাসা থেকে কলেজ পর্যন্ত সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে ইট বহন করে কলেজ প্রাঙ্গণ পর্যন্ত ইট পৌঁছে দেয়। ছাত্রদের থেকে সংগ্রহীত অর্থ ও আওয়ামীলীগ নেতাদের অর্থে সারারাত কাজ করে বর্তমান কলেজ মসজিদের পার্শ্বে ৫/৬ ফুটের একটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়।
পরের দিন আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে নিয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণে এই শহীদ মিনারেই প্রথম পূষ্প্যমাল্য অর্পণ করা হয়। তার পরবর্তীতে ভাষা শহীদদের স্মরণে স্থাপিত এই শহীদ মিনারটি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাতের আঁধারে রাজাকাররা ভেঙ্গে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমান কলেজ গেইটে শহীদ মিনারটি স্থায়ীভাবে পূণঃ স্থাপন করা হয়। পরে ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী লক্ষ্মীপুর জেলা হবার পর ১৯৮৫ সালে রেহান উদ্দিন ভূঁঞা সড়কে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম এম দত্ত ও স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের আন্তরিক প্রচেষ্টায় জেলা পরিষদের অর্থায়নে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার স্থাপিত হয়।
এরপর থেকেই এ শহীদ মিনারে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং শহীদ মিনারের পাদদেশে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, সভা-সেমিনার করে আসছিল। ২০০৬ সালে বড় আকারে লক্ষ্মীপুর সার্কিট হাউজের সামনে জেলা পরিষদের অর্থায়নে লক্ষ্মীপুর জেলা শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়।
তারপর থেকে বর্তমান জেলা শহীদ মিনারে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং শহীদ মিনারের পাদদেশে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, সভা-সেমিনার করে আসছে।