বাংলা প্রেস, নিউ ইয়র্ক থেকে :: যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আবারও গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। নিজগৃহে কর্মরত গৃহকর্মী মোহাম্মদ আমিনের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলামকে স্থানীয় সময় সোমবার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
শাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার বাসায় এক বাংলাদেশি নাগরিককে তিন বছরের বেশি সময় ধরে সহিংস নির্যাতন ও হুমকি দিয়ে বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য করেছেন। গত বছর একই ধরনের অভিযোগ উঠেছিল এ দূতাবাসের সাবেক কনসাল জেনারেল মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তাঁকে সস্ত্রীক আটক করার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।মামলা দায়েরের আগেই মরক্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান এবং সেখানে যোগদান করেন মনিরুল ইসলাম।
কুইন্স কাউন্টির অ্যাটর্নির অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের সূত্র থেকে জানা যায়, ডেপুটি কনসাল জেনারেল (৪৫) কুইন্সের পাশেই জ্যামাইকা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। মোহাম্মদ আমিন নামের গৃহকর্মী যুক্তরাষ্ট্রে আসার পরপরই অভিযুক্ত শাহেদুল ইসলাম তার পাসপোর্ট কেড়ে নেন এবং তাকে দিয়ে দৈনিক আঠারো ঘণ্টা কাজ করাতে বাধ্য করান বলেও অভিযোগ এসেছে।
নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামিম আহসান জানিয়েছেন, অভিযুক্ত শাহেদুল ইসলামকে ৫০ হাজার ডলার বন্ডে তিনি জামিন আদেশ দেওয়া হয়েছে তবে তিনি এখনো মুক্ত হননি। তাকে ১২ জুন সকালে আটক করে পুলিশ।
নিউ ইয়র্কের কুইন্সবরোর অ্যাটর্নি রিচার্ড ব্রাউন এ অভিযোগকে খুবই উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছেন। আগামী ২৮শে জুন তাকে আবারো আদালতে হাজির হতে হবে। বাংলাদেশি দূতাবাস কর্মকর্তা আনুমানিক ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত কোনো ধরনের অর্থ ছাড়াই একজন ব্যক্তিকে তার বাড়িতে কাজ বাধ্য করেন। এরপর মোহাম্মদ আমিন নামে ওই ব্যক্তি গত বছর মে মাসে পালিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান।
ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি রিচার্ড এ ব্রাউন এক বিবৃতিতে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ অত্যন্ত উদ্বেগজনক। একজন কনস্যুলার তার বাড়িতে আরেকজনকে কাজে বাধ্য করতে শারীরিক জোর খাটিয়েছেন ও হুমকি দিয়েছেন। সেইসঙ্গে প্রথম দিন থেকেই ওই কর্মীকে কাজে আটকে রাখার জন্য তার পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছেন। তাকে বেতন দিতে অস্বীকার করেছেন এবং অন্য দেশে থাকা তার পরিবারকে বিপদে ফেলার ভয়-ভীতি দেখান। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে নিশ্চিতভাবেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার জন্য শাস্তি পেতে হবে।
শাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে ১৫ বছরের জেল খাটতে হতে পারে। কনস্যুলেট কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সবোর্চ্চ চেষ্টায় রয়েছেন আইনি পদক্ষেপ মোকাবেলার জন্য। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামিম আহসান জানান, তারা মনে করেন অভিযোগকারী ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের আশায় এ ধরনের অভিযোগ করেছেন, যা সত্য নয়।
অপর দিকে, গৃহকর্মী নির্যাতন মামলায় সময়মতো হাজিরা না দেওয়ায় নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের সাবেক কনসাল জেনারেল মনিরুল ইসলামকে সস্ত্রীক আটক করার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। গত ২০১৬ সালের ১৩ মে ম্যানহাটান জেলা আদালতের বিচারক সিডনি স্টেইন এ আদেশ দেন।
মামলা দায়েরের আগেই মরক্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান মনিরুল ইসলাম। তিনি এখন ইথিওপিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। কূটনীতিক মনিরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী ফাহিমা তাহসিনা প্রভার বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন তাঁদের সাবেক গৃহকর্মী মাসুদ পারভেজ রানা। মামলার অভিযোগে বলা হয়, বিবাদীপক্ষ তাঁকে পারিশ্রমিক ছাড়াই দাসের মতো কাজ করতে বাধ্য করত।
ম্যানহাটান জেলা আদালতের বিচারক সিডনি স্টেইন বলেন, আদালত খুব সহজে ডিফল্ট জাজমেন্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় না। আদালত ১৫ মাস অপেক্ষা করেছেন; অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা বিচারকাজে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই আদালত বাধ্য হয়ে ডিফল্ট জাজমেন্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মাসুদ পারভেজ রানা অভিযোগে বলেন, তাঁকে মাসে তিন হাজার ডলার পারিশ্রমিক এবং ভিসা নবায়নের কথা বলে গৃহস্থালি কাজের জন্য নিউ ইয়র্কে নিয়ে আসেন মনিরুল ইসলাম ও প্রভা। এক বছরের বেশি সময় ধরে দিনে ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করানো হয় তাঁকে দিয়ে। কিন্তু পারিশ্রমিক দেওয়া হয়নি তাঁকে; বরং পালানোর চেষ্টা করলে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়।
গত বছর মরক্কোতে অবস্থানকালে মামলার অভিযোগ প্রসঙ্গে দৈনিক কালের কন্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ তৈরি করতেই এ মামলা করা হয়েছে। আমাদের ফাঁসানো হয়েছে।’
মনিরুল ইসলাম বলেন, গত বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে রানার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তিনি রানাকে বলছিলেন, ইচ্ছা করলে তিনি তাঁর সঙ্গে মরক্কো যেতে পারেন; না হলে বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। এ কথা শুনে রানা বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোথাও যাবেন না।
কূটনীতিক জানান, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে রানাকে তিনি ঢাকা থেকে সঙ্গে করে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যান। তবে তাঁর ভিসার আবেদনে তিনি স্বাক্ষর করেননি। প্রতি মাসে তাঁকে তিন হাজার ডলার ভাতা দেওয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে তাও সত্য নয়।
মনিরুল ইসলাম বলেন, রানার বাবা ঢাকার কচুক্ষেতের ব্যবসায়ী নাসিরুদ্দিন ছেলের বেতন থেকে সমন্বয় করে নেওয়ার শর্তে তাঁর কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নেন। এ ব্যাপারে লিখিত দলিল রয়েছে। সুতরাং রানাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়নি, এ অভিযোগ একেবারেই সত্য নয়। তিনি জানান, একদিন তাঁর পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে বাসা থেকে চলে যান রানা। রাত ১১টায় বাসায় ফিরে তাঁরা দেখেন রানা নেই। সম্ভাব্য সব জায়গায় যোগাযোগ করেও তাঁর হদিস পাননি তাঁরা। তখন তাঁদের ধারণা হয়, রানা হয়তো কোথাও আশ্রয় পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সে (রানা) যদি আইন লঙ্ঘন করে নিজ দায়িত্বে যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে চায়, তাহলে আমি বা আমরা থামাব কিভাবে?’
রানার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসকে টেলিফোন করে জানান মনিরুল ইসলাম। তবে পুলিশে অভিযোগ করেননি তিনি। তাঁর ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে রানার মামলা করার খবর গণমাধ্যমে প্রথম দেখেন তিনি।
নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ একই ধরনের। তারা কোন আইনিজীবির পরামর্শেই যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যেই পরিকল্পিতভাবেই এ ধরনের অভিযোগ ও মামলা করা হচ্ছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।