লেখক: মিলন আহমেদ

২৫ আগষ্ট। ১৯৬২ সালের এইদিনে ময়মনসিংহ শহরে জন্ম নিয়েছিলেন একজন মেয়ে। তসলিমা নাসরিন। কেউ সেদিন ভাবতে পারেনি যে এই তসলিমা নাসরিনই একদিন হয়ে উঠবে বিশ্বের আলোচিত একজন মানুষ। চার লক্ষ লোক (না-বুঝেই) তাঁর ফাঁসির জন্য রাজপথে নেমে মানব ইতিহাসের রেকর্ড সৃষ্টি করবে, দেশ থেকে তাঁকে বিতাড়িত হতে হবে, বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী দেশসমূহের মানুষের কাছে তিনি আদরীয়-সম্মানীয়-পূজণীয় হবেন।

তবে সেদিন কেউ ভাবতে না পারলেও এখন ভাববার সময় এসেছে যে, চিন্তায় অগ্রসর জাতিসমূহ যাঁকে সেলুট দিচ্ছেন একই কর্মের জন্য একই ব্যক্তিকে দীর্ঘসময় অবজ্ঞা করা আমাদের চিন্তার অসাঢ়তা ছাড়া কিছুই নয়।

তসলিমা নাসরিনের প্রতি দুর্ব্যবহারের কারণ যত তাড়াতাড়ি আমরা উপলদ্ধি করতে পারব ততই এ জাতির মঙ্গল। আমাদের লক্ষ্য করা জরুরী যে, ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের কারণে তসলিমা নাসরিনের এত শত্রুর সৃষ্টি হয়েছিল না। মানবতার গান গাইতে গিয়েই তিনি বিপদে পড়েছেন।

শুধু তসলিমা নয়, সভ্যতা বিনির্মানে যে সকল মহামানব সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন তাঁদের কেউই সুখে ছিলেন না। মানুষ নামক জীবকে বন্যজীবন থেকে আধুনিক প্রাণীতে পরিণত করতে যাঁরা নিবেদিত ছিলেন তাঁদের সবাইকে সহ্য করতে হয়েছে বর্ণনাতীত নির্মমতা, দিতে হয়েছে জীবন, হতে হয়েছে নির্বাসিত। তসলিমাও ব্যতিক্রম নন।

অমানবিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাঁকে আক্রান্ত হতে হয়েছে। ধর্ম-বৈষম্য এবং লিঙ্গ-বৈষম্যের বিপক্ষে লিখতে গিয়ে তাঁর মাথার মূল্য ঘোষিত হয়েছে, জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয়েছে, বিতাড়িত হতে হয়েছে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে।

সমপ্রতি একাত্তর টিভিতে পাঁচদিনব্যাপী তসলিমা নাসরিনের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। তসলিমা সম্পর্কে এদেশের মানুষের বিভ্রান্তি দূর করতে সাক্ষাৎকারটি বেশ গুরুত্ব বহন করে, যা আরও আগেই প্রচারিত হওয়া দরকার ছিল। উক্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের নারীদের প্রতিবেশী দেশসমূহের তুলনায় এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে বটে তবে তার মূল কারণের কথা উজ্জ্বই থেকে গেছে।

পুরুষতন্ত্রের নির্মম কষাঘাতে নারী কিভাবে জর্জরিত তা নির্বাসনে যাওয়ার আগে তসলিমা নাসরিন তাঁর কলমের দ্বারা নিখুঁতভাবে দেখিয়েছিলেন বলেই যে এদেশের নারীর সামান্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা ফারজানা রূপা এবং তসলিমা কেউই বললেন না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রের চরমরূপ বিরাজমান থাকায় তসলিমাকে ঘৃণিত হতে হয়েছিল বটে তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে তসলিমার নির্দেশিত যুক্তিগুলি ছিল অভেদ্য এবং গ্রহণযোগ্য। একই কারণে তসলিমার সেই অকাট্য যুক্তিগুলি অন্য লেখকরা এখন প্রদর্শন করলেও তা আর আগের মতো ঝড় তোলে না। প্রকাশ্যে তসলিমাকে মেনে না-নিলেও তাঁর কথাগুলো অনেকেই উপলদ্ধি করতে পেরেছে। উপলদ্ধি করেছে বলেই নারী নির্যাতন দমনের জন্য আইন হয়েছে, নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় নারীর ক্ষমতায়নের গতিও কিছুটা ত্বরান্বিত হয়েছে।

তবে একটি বিষয় উল্লেখ করা অত্যন্ত জরুরী যে, এদেশের নারীরা এখনও যে পরিমান পাশবিক নির্যাতনের শিকার তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। মার্কস অলরাউন্ডার পুরস্কার পাওয়া মেয়েটিও রক্ষা পায়নি, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে হাসপাতালের বিছানায়। যেদেশে প্রত্যেক নারীকেই সকল সময়েই এক ধরনের শঙ্কা নিয়ে জীবন অতিক্রম করতে হয় সেদেশের নারী কতটুকু ক্ষমতায়িত হয়েছে তা বিবেচনার বিষয়। অগ্রগতি হলেও তা খুবই নগন্য। এসব সামান্য অগ্রগতির কারণে আমাদের সরকার প্রধানকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতে দেখা যাচ্ছে এবং বিদেশী অতিথিরা বাংলাদেশের প্রশংসা করছেন বটে কিন্তু যাঁর মূল অবদান তাঁকে আজও নির্বাসিতই থাকতে হচ্ছে।

আর কতকাল তসলিমা নাসরিনকে নির্বাসিত থাকতে হবে এ প্রশ্ন কার কাছে করবো জানিনা। তবে আমার দেখা জাতির সর্বাধিক এই দেশপ্রেমিককে দেশে ফিরতে না দেয়ায় আমার কষ্ট হয়, দুঃখ হয়, লজ্জাও লাগে। কবিতার মধ্যে দিয়ে তসলিমা বুঝিয়েছেন “আমার উরু কেটে নিলে দেখা যাবে এক থাক মাংস ছাড়া কিছু নেই। হাতের, পায়ের শিরা কাটলে দেখা যাবে ফিনকি ওঠা রক্ত। চোখের মণি, ফুসফুস, পাকস্তলী, যকৃত, পিত্তথলি, জরায়ু ইত্যাদি ছিঁড়ে দেখলে কিছুই পাওয়া যাবে না।

মস্তিস্ক, শিরদাঁড়া, পিঠ, পেট, বৃক্ক ইত্যাদি খুললে দেখা যাবে ফাঁকা। কিন’ হৃৎপিন্ডে হাত দিলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে এতে কিছু আছে, ছিঁড়লে দেখা যাবে ভেতরে একটি দেশ, বাংলাদেশ নাম।” ইস!! তিনি কী অস্বাভাবিক দেশপ্রেমিক তা আমরা কি কেউ ভেবে দেখেছি? মহান এই ব্যক্তিকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আমরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছি, খাচ্ছি, হাঁটছি, আড্ডা দিচ্ছি, আরামছে ঘুমাচ্ছি, সবই করছি। হায় বাঙালি ! হতভাগা জাতি !! কোন অপরাধে তসলিমা নাসরিন দেশান্তরী? তসলিমা কি কারো মাথায় লাঠি মারতে গেছেন? না, কেউই কোনো মানুষের মাথায় লাঠি মারবে না, এই নীতিতে তিনি বলিয়ান।

বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণের সময় তিনি ব্যাথিত হয়ে যেমন ‘লজ্জা’ লিখেছিলেন তেমনি গুজরাটের মুসলমানদের উপর আক্রমণের সময় তিনি ভিকটিমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গাজায় ইসরাইলী গণহত্যার প্রতিবাদ যেমন তিনি করেছেন একই রকমভাবে হামাস-আইএসআই-আলকায়েদা-তালেবান জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার। বলা হচ্ছে তসলিমা নাস্তিক। হ্যাঁ, তিনি নাস্তিক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী নাস্তিকতা, হিন্দুত্ব, মুসলমানিত্ব কোনো অপরাধ নয়। মুসলমান, হিন্দু, নাস্তিক, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সবাই সমানভাবে এদেশের নাগরিক এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিককে রাষ্ট্র সমানভাবে নিরাপত্তা দেবে। তাই গণতন্ত্র। তসলিমা লেখেন, তাঁর লেখা সবার পছন্দ হতে হবে এমন কোনো কারণ নেই। তাঁর বিরোধীরাও লেখছে এবং লেখবে, এতে কোনো সমস্যা হবে না, তাই হবে গণতন্ত্র। তাহলে অগণতন্ত্র কি? কারো মাথার মুল্য ঘোষণা করা শুধু অগণতন্ত্রই নয়, বরং তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় অগণতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের পাসপোর্ট নবায়ন না করা।

তসলিমাকে আজ বড় প্রয়োজন। তসলিমার জন্য নয়, আমাদের জন্য প্রয়োজন। এদেশের নির্যাতিত-নিপিীড়িত মানুষের জন্য প্রয়োজন, অবহেলিত-লাঞ্চিত নারীর জন্য প্রয়োজন। এদেশের কোটি কোটি গৃহবধূর করুণ আর্তনাদ আমাদের কানে বাজে, তাই তসলিমাকে আজ সত্যি প্রয়োজন।

আমরা দেখতে পাই এদেশের নারীরা পরিগণিত হচ্ছে পুরুষের যৌন-সামগ্রী হিসেবে, নারীকে মনে করা হচ্ছে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র-বিশেষ, ভয়াবহ পারিবারিক সহিংসতা সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিরাজমান, নারী আজ শিকার হচ্ছে দলধর্ষণের, ধর্ষণ থেকে রেহায় পাচ্ছে না শিশু, ঘন্টায় ঘন্টায় নারীর আত্মহত্যার খবর আসছে এবং সন্তানকে সাথে নিয়ে মা আত্মহত্যা করছে, এখনও দোর্‌রা মারার সংবাদ আসছে, পুরুষের বহুবিবাহের মতো ঘৃণ্য প্রথা এদেশে খুবই স্বাভাবিক বিষয় এবং তা সমর্থন করছে রাষ্ট্রীয় আইন, উত্তরাধিকারে নারীকে করা হচ্ছে সম্পদহীন, বাল্যবিবাহ চলছে অতিমাত্রায়, যৌতুক প্রথা আজ নারীর জীবনকে বিভীষিকাময় করে তুলেছে, এসিড নিক্ষেপ করে ঝলসে দেয়া হচ্ছে নারীর মুখমন্ডলসহ সারা শরীর, দেদারছে পাচার হচ্ছে নারী নামক পণ্য, পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে নারীকে।

তাই বলবো, মানবতার জন্য তসলিমাকে আজ এদেশের মানুষের বড় প্রয়োজন। জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজন, বাঁচার জন্য প্রয়োজন। মনুষ্যত্ব সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন, বাক-স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন, মানবিকতার জন্য প্রয়োজন, মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজন, মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয়ার জন্য প্রয়োজন, প্রগতিকে গতি দেয়ার জন্য প্রয়োজন। পরিবারের সুস্থতার জন্য প্রয়োজন, সুস্থ সমাজের জন্য প্রয়োজন, সভ্য জাতির জন্য প্রয়োজন। কুসংস্কারের গ্রাস থেকে বাঁচতে তসলিমা নাসরিনকেই এ জাতির আজ বড় প্রয়োজন। সকল অন্ধকারকে সরিয়ে আলোর পথ দেখতে তাঁকে প্রয়োজন, আধুনিকতার রাস্তায় হাঁটতে তাঁকে প্রয়োজন।

এদেশের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের জন্য প্রয়োজন, মানবমুক্তির জন্য প্রয়োজন, দাসত্বমুক্তির জন্য প্রয়োজন, ধর্মীয় তান্ডব থেকে রেহাই পেতে প্রয়োজন, মুক্তচিন্তার জন্য প্রয়োজন, সংখ্যালঘূ সমপ্রদায়ের নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে প্রয়োজন, গণতন্ত্রকে জীবিত রাখতে প্রয়োজন, একাত্তরের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন, অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে প্রয়োজন। ধর্মের নামে অধর্ম দূর করতে প্রয়োজন, মানুষকে প্রকৃত ধার্মিক করতে প্রয়োজন তথা মানবধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে তসলিমাকে আজ বড় প্রয়োজন। পুরুষতন্ত্রকে কবর দিয়ে সত্যিকার মানুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন।

শুভবুদ্ধির বিকাশের জন্য প্রয়োজন, মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন, সমতার জন্য প্রয়োজন, সাম্যের জন্য প্রয়োজন। মানুষে-মানুষে এবং পুরুষ-নারীতে বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন। নারীকে স্বাবলম্বী করতে প্রয়োজন, নারীর অসহায়ত্ব দূর করতে প্রয়োজন, নারীমুক্তির জন্য প্রয়োজন, নারীকে মানুষের পর্যায়ে আনতে প্রয়োজন, অমানুষ-পুরুষকে মানুষ বানাতেও প্রয়োজন। কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তসলিমা নাসরিনকে দেশে ফিরিয়ে আনুন।

 

লেখক: কলেজশিক্ষক এবং নারীবাদীকলাম্‌নিস্ট, ঈশ্বরদী, বাংলাদেশ।

ইমেইল: milon.ahmed8@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here