তেঁতুলিয়া ভ্রমন
জামান আরশাদ
গত ২৯/১১/২০১৭ হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত হলো তেঁতুলিয়া বেড়াতে যাব।শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি, তারসাথে শনিবার ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী’র বন্ধ। বৃহস্পতিবার রাতের গাড়ীতে রওয়ানা দিয়ে শুক্রবার শনিবার ওখানে থেকে শনিবার রাতে আবার তেঁতুলিয়া থেকে রওয়ানা দিয়ে রবিবার সকালে ঢাকায় পৌছাবো এভাবে চিন্তা করা হলো। কিন্তু হুট করে চাইলেই তো সবকিছু হয়না। সাধারনত পর পর ২/৩ দিন ছুটি থাকলে যেকোন জায়গারই বাসের টিকিট পাওয়া দুষ্কর। তার উপর চিন্তা ছিলো তেঁতুলিয়ায় থাকার বিষয়টি। কারন, সেখানে এখনো তেমন ভাল মানের কোন আবাসিক হোটেল হয়নি।তারপরও ইচ্ছে বলে কথা।
ধরেই নিয়েছিলাম যে কাউন্টারে গেলে স্বাভাবিক নিয়মে টিকিট পাওয়া যাবেনা। অগত্যা রংপুরে ছোটভাইকে ফোন করলাম টিকিটের ব্যাপারে। সে জানালো, কিছুক্ষণ পর ফোন করে জানাবে টিকিটের বাস্তবিক অবস্থা। প্রসঙ্গত বলে রাখি, সে আবার রংপুর জেলা মটর মালিক সমিতির নেতা। কয়েক মিনিট পরেই সে ফোন করে জানালো যে টিকিট কনফার্ম করা হয়েছে, কাউন্টারে যেয়ে কেটে নিয়ে আসতে হবে।
এরপর আসলো আসল চিন্তা, তেঁতুলিয়া যেয়ে থাকবো কোথায় ?হঠাৎ মনে পড়লো একটি ছেলের কথা, সহজ সরল অমায়িক স্বভাবের একটি ছেলে। যার সাথে বিভিন্ন বাংলা ব্লগে লেখালেখির সুত্র ধরে অনেক আগেই পরিচয়। আমরা সবাই তাকে ডাকতাম “দোয়েল পাখি” বলে। তার পুরো নাম এস কে ওয়েল। স্থানীয় সাংবাদিক ও লেখক। অগত্যা তাকেই ফোন করে জানালাম ইচ্ছের কথা। তাৎক্ষনিক সে আমাকে অপেক্ষায় রেখে অন্য ফোন থেকে একটি আবাসিক হোটেলে ফোন করে থাকার ব্যবস্থা করলো এবং আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানালো যাবার জন্য।আমার স্ত্রী লুবনা আমাকে বললো, সেখানে নাকি একটা ডাকবাংলো আছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আমি জানালাম, যতদূর জানি এই ডাকবাংলোগুলো সাধারণত সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে, সাধারন জনগনের জন্য নয়।
কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান ভাইয়ের কথা।ওনাকে ব্যাপারটা জানাতেই বললেন যে তুমি পঞ্চগড় সুগার মিলের ডাকবাংলোয় এসে থাকবে। প্রতিউত্তরে জানালাম আমরা তো যাবো তেঁতুলিয়া।সেখানে নাকি একটা ডাকবাংলো আছে, ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আর তাছাড়া পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়ার দূরত্বও তো একেবারে কম নয়, পঞ্চগড়ে থাকলে পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়ায় যাওয়া আসারও একটা বাড়তি চিন্তা থাকবে। পরে উঁনি তেঁতুলিয়ায় নব নির্মিত জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রধান ভাই।
অবশেষে তেঁতুলিয়ায় পৌছালাম শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে।সাধারনত সকাল ৭/৮ টার মধ্যেই পৌছে যায়।দেরী হল কারণ আগের রাতে রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম ছিল।বাস থেকে নেমে একটা ব্যাটারী/মটর চালিত ভ্যানে উঠে রওয়ানা দিলাম পূর্ব নির্দেশিত জেলা পরিষদ ডাক বাংলোর উদ্দ্যেশে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এখানে একমাত্র বাহনই ব্যাটারী/মটর চালিত অটো বা ভ্যান।
ডাকবাংলোর গেটে পৌছেই দেখি সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষমান “দোয়েল”। শুরু হলো দোয়েলের আমাদের সার্বিক্ষনিক সঙ্গী হওয়া। আমরা রুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নিলাম।দোয়েল অপেক্ষা করতে থাকলো। ফ্রেস হয়ে দোয়েল সহ বের হলাম দুপুরের খাবার খেতে।
ওহহ, কি যে টাটকা খাবার। কয়েক রকমের ভর্তা, ভাজি, সবজি, তেঁতুলিয়ার মহানন্দা নদীর টাটকা ছোট মাছ,কবুতরের মাংস। শেষ কবে কবুতরের মাংস খেয়েছি মনে পড়েনা। খাবার শেষে আসলাম চা খেতে। তেঁতুলিয়ার নামের সাথে জড়িয়ে আছে যেই তেঁতুল গাছ, চৌরাস্তার মোড়ে সেই তেঁতুল গাছের তলায় মনকাড়া চা খেলাম “রফিক” এর চায়ের দোকানে। গরুর খাঁটি দুধের চা। আর রফিকও খুব আন্তরিকতার সাথে আমাদের চা খাওয়ালো, যেহেতু দোয়েল আগেই তাকে আমাদের সম্পর্কে বলেছে। তাই একটু আলাদা আপ্যায়ন করলো। পরবর্তীতে দুইদিন যে কয়বার চা খেয়েছি, রফিকের দোকানের চা-ই খেয়েছি।
তারপর যাত্রা শুরু হলো একটা ব্যাটারী/মটর চালিত অটোতে বাংলাবান্দা জিরো পয়েন্ট ও বাংলাবান্দা স্থলবন্দর পরিদর্শনের উদ্দ্যেশে। সেখানে যেয়ে দেখতে পেলাম দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সান্ধ্যকালীন যৌথ মহড়া।
সন্ধ্যার মধ্যেই আবার তেঁতুলিয়ায় ফিরে হালকা নাস্তা ও আবার রফিকের দোকানের চা খেয়ে, রাতের খাবার সাথে নিয়ে ঐদিনের মতো আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে গেলাম। সন্ধ্যার পর আবার বের হলাম ডাকবাংলো লাগোয়া মহানন্দা নদীর সৌন্দর্য দেখতে।
কিছুক্ষণ পর রুমে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। যেহেতু আগের রাতে ভ্রমণের ক্লান্তি, সাথে সারাদিনের ঘুরাঘুরির ধকল। শরীরও ছিল ক্লান্ত।
শনিবার (৩০/১১/২০১৭) ভোর ৫.৩০টায় উঠেই আবার গেলাম মহানন্দার পাড়ে, উদ্দ্যেশ্য হিমালয়ের চুড়া দেখা।যদিও আমরা যাওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই আর দেখা যাচ্ছিলো না অতিরিক্ত কুয়াশার কারনে।কিন্তু আমরা ভাগ্যবান একারনে যে, শনিবার তেমন কুয়াশা না থাকার জন্য পরিস্কার দেখতে পেলাম। এরপর মহনন্দা নদীর পাড় দিয়ে অনেকদূর হাটাহাটি করে এসে সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো চায়ের দোকানে বসলাম চা খেতে। একদিকে নদী, নদীর ওপাড়ে বিস্তৃর্ণ সবুজ চা বাগান আর পাহাড়। মনমুদ্ধকর অপরুপ দৃশ্য। তৎসঙ্গে দেখতে থাকলাম স্থানীয় কিছু মানুষ ঐ সময়েই নদীতে নামছে পাথর সংগ্রহের জন্য। এই পাথরই এখন এখানকার অনেক মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। ভারত থেকে মহানন্দা নদী দিয়ে এইসব পাথর ভেসে আসে। যদিও মহানন্দা নদীর বেশিরভাগ অংশই পড়েছে ভারতের সীমান্তে।
চা খেতে খেতে দেখা হয়ে গেল তেঁতুলিয়ার আরেক উদ্দ্যমী তরুণ, সংস্কৃতিকর্মী, সমাজকর্মী মোবারক হোসেনের সাথে।অত্যন্ত প্রাণবন্ত, মিশুক। অল্প কিছুক্ষণের আলাপে হয়ে গেল আন্তরিক, আপন। দোয়েল, মোবারক ও তাদের সমমনা কয়েকজন মিলে তেঁতুলিয়ায় পর্যটন বিকাশে ও পর্যটকদের নানাবিধ সহযোগিতার উদ্দ্যেশ্যে “তেঁতুলিয়া ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম” নামে একটি নতুন উদ্দ্যোগ নিয়েছে। তেঁতুলিয়া ভ্রমণের পূর্বে প্রয়োজনে আপনারাও তাদের সাথে https://www.facebook.com/groups/tetulia.travel/ এই ঠিকানায় যোগাযোগ করে যেতে পারেন।
নাস্তা করে দোয়েল সহ আমরা দু’জন ব্যাটারী/মটর চালিত অটো নিয়ে রওয়ানা হলাম তেঁতুলিয়া থেকে ১৬/১৮ কিঃ মিঃ দূরে প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন ভিতরগড় দূর্গ দর্শনে। সেখানে দূর্গের সাথেই রয়েছে “মহারাজার দীঘি” নামে বিশাল এক দীঘি। প্রথমেই ঘুরে দেখলাম সেই দীঘি। দীঘির পাড়ে তখন সৌখিন মাছ শিকারীরা মাছ শিকারে ব্যস্ত। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখলাম “ভিতরগড় দূর্গর বিভিন্ন নিদর্শন। http://www.thebengalitimes.com/feature/2017/11/27/31541 এই ঠিকানায় পাবেন ভিতরগড় দূর্গের বিস্তারিত।এখানে ঘুরতে ঘুরতেই হয়ে গেল বিকেল।
বিকেলে এখান থেকে রওয়ানা দিলাম “কাজি এন্ড কাজি’স টি রিসোর্ট” এর আনন্দধারা নামক মনোরম এক জায়গা দর্শনের উদ্দ্যেশে। সেখানে সাধারন মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। দোয়েল আগে থেকেই আমাদের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে রেখেছিল। পথিমধ্যে হঠাৎ দোয়েল এক বাড়িতে আমাদেরকে নিয়ে উপস্থিত। জানালো সেটা তার শ্বশুরবাড়ি। আমরা দু’জন তো অপ্রস্তুত। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে সেখানে নিয়ে যেয়ে হাজির। তার আগেরদিন অবশ্য জানিয়েছিল যে তার শ্বাশুড়ি অসুস্থ। সে সেই দ্বায়িত্ব ছেড়ে মনের টানে আমাদেরকে সময় দিয়েছে।দোয়েলকে এজন্য ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবোনা। অল্প সময়ের জন্য হলেও, দোয়েলের শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী ও বৌয়ের আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ, বিমোহিত।
অবশেষে ঢুকলাম কাজি এন্ড কাজি’স টি রিসোর্টের “আনন্দধারা”য়।এদেশে অনেকেই বিপুল টাকার মালিক। কিন্তু সবার মানসিকতা, রুচি এক নয়।শুধু টাকা থাকলেই সব হয়না। নান্দনিক কিছু করতে হলে টাকার সাথে সাথে থাকতে হয় সুন্দর মন ও রুচি।প্রচলিত একটা কথা আছে- “আল্লাহ যাদের ধন দেন, তাদেরকে নাকি মন দেন না।“কিন্তু এখানে আসলে কথা ভুল প্রমানিত হতে বাধ্য। কি অপরুপ সাজে সাজিয়েছেন পুরো এলাকাটা।ঘুরে ঘুরে পুরো এলাকাটা মন ভরে দেখলাম এবং কিছু সুন্দর স্মৃতি নিয়ে আসলাম।
তেঁতুলিয়ায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।রাতে ফিরতি বাস। তাই ডাকবাংলোয় ফিরে ফ্রেস হয়ে চলে এলাম বাস কাউন্টারের সামনে। সঙ্গে দোয়েল ও মোবারক।শেষবারের মতো রফিকের দোকানে চায়ের অর্ডার করলাম।এরই মধ্যে দেখা ডি এফ বি সাকিল নামের সুদর্শন এক যুবকের সাথে।সেও সংবাদকর্মী। তবে মানবাধিকার ও মাদকের বিরুদ্ধে তার কন্ঠ ও লেখনী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার।
সুন্দর দু’টি দিন কাটিয়ে এবার ফেরার পালা।দোয়েল, মোবারক, শাকিল সবার আন্তরিকতা ও আতিথেয়তায় সত্যিই আমরা মগ্ধ, বিমোহিত। আলাদা করে বলার মতো আর কিছু নেই। তোমাদের স্থান আমার হৃদয়ের সর্ব্বোচ্চে। তোমাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল ও শুভ কামনা সবসময়।
লেখকের ই-মেইলঃ zaman@mail2bangladesh.com