মোমিন মেহেদী::

images111111111‘দীপন ভাইয়ের একটা ছোট গাড়ি আছে। সাদা। পুরাতন মডেল। আজিজ মার্কেটের নিচে এক কোনায় পড়ে থাকে। মনে হয় মন খারাপ করে বসে আছে। শেষবার যখন দীপন ভাই ডেকেছিলেন, তখনই প্রথমবারের মতো গাড়িটি দেখেছি। মেলার পরবর্তী বইয়ের নাম ফেসবুকে দিতেই দীপন ভাই সন্ধ্যায় ডাকলেন। আমি, নোমান আর আসাদ। কাঁচা আমের মিষ্টি শরবত খাইয়ে সেই গাড়ীতে করে আমাকে বাসষ্ট্যান্ডে নামিয়ে গেলেন। নামার আগে বললাম, ভাই, হুদাই কষ্ট করলেন। দীপন ভাই স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বললেন, এখন রাত ১১টা। আমার লেখককে নিরাপদে রাখতে যতটুকু পারি চেষ্টা করলাম। আহ! ‘নিরাপদ’ শব্দ। খুব অসহায় লাগছে, দীপন ভাই। একদম বড় ভাইয়ের মতো খাতা খুলে হিসাব দেওয়া প্রকাশক ছিলেন আপনি আমার। আদর্শ লিপির প্রতিটি কপিতে আপনার মমতা ছিলো অগাধ। দীপন ভাই, শুধু কারও বই প্রকাশ করার অপরাধে এভাবে চলে যেতে হবে আপনাকে? আপনার সেই নতুন লেখকদের সুযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া, ভালো বই প্রকাশের আগ্রহ, লেখকের সাথে অকৃত্রিম ভালোবাসা এতোসব এভাবেই হারিয়ে যাবে চাপাতির আঘাতে? জানিনা দীপন ভাই। জানার আগ্রহও নেই। আমি আসলে আরও অনেকগুলো বছর আপনার প্রকাশনীর লেখক থাকতে চেয়েছিলাম। সেই উত্তর হয়তো আজ আপনি রক্তেই লিখে গেলেন, কী লাভ এই দেশে এইসব লেখালেখির?’

সাংবাদিক বন্ধু ইশতিয়াক আহমেদ-এর প্রশ্ন এখন ষোল কোটি মানুষের প্রশ্ন। এমনিতেই আমাদের তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থার ধারক-বাহক, সংসার আর রাজনীতিকদের রাজনীতি লেখক-কলামিস্ট-ব্লগার-কবি-সাত্যিকদেরকে বাঁকা চোখে দেখে; তার উপর আবার একের পর মুক্তমনা মানুষ হত্যার ঘটনায় আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি শুধু উদ্বীগ্নই নয়; তারা এখন নতুন প্রজন্মের প্রতিটি প্রতিনিধির পায়ে শেকল পড়ানোর রাস্তায় এগিয়ে চলতে শুরু করেছে। আমরা স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি-কূটনীতি এবং শিক্ষানীতি সচেতন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা যখনই অন্যায়ের বিরম্নদ্ধে সোচ্চার হয়েছি; ছিক তখনই ড়্গমতাসীনরা আমাদের কন্ঠ স্তব্ধ করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। এর প্রমাণ নীল চাষ বিরোধী আন্দোলন; ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন; রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন; স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলনের ইতিহাস সবসময় দিয়ে এসেছে; এখনো দিচ্ছে। তারপরও নতুন প্রজন্ম প্রত্যয়ী-প্রত্যাশী-সাহসী। জীবন দিতে তারা কখনো পিছপা না হলেও চায় অধিকার; চায় শান্তি; চায় সম্মৃদ্ধি এবং উন্নয়ন। এই চাওয়াটাকেই রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের মত ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়ে অতিতের মত বর্তমানেও দেশ বিরোধীচক্রকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে আসছে। যার প্রমাণ কথায় কথায় ব্লগার খুন; নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি খুন এবং হামলা-মামলা-গুম। বিশেষ করে বললে বলা যায়, ব্লগার রাজীব হায়দার; অনন্ত বিজয় দাস; ওয়াশিকুর রহমান; নীলাদ্রী চ্যাটার্জী নিলয়; অভিজিৎ রায়ের হত্যার বিচারের সূচনাও যখন ঠিক মত করতে পারে নি বর্তমান সরকার; ঠিক তখনই নির্মমভাবে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের উপর নেমে আসলো অশনী সংকেত একটি চরম নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে। বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের মতো খুন হলেন তার বইয়ের প্রকাশন প্রতিষ্ঠান জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ও দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদ-রাজনীতি গবেষক আবুল কাশেম ফজলুল হকের সন্তান ফয়সাল আরেফিন দীপন। জামায়াত-শিবির-স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের পৃষ্টপোষকতায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে চলে যায়। শুধু এখানেই শেষ নয়; একই সময় রাজধানীর লালমাটিয়ায় নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন অভিজিৎ রায়ের আরো একটি আলোচিত বইয়ের প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল এবং ব্লগার তারেক রহিম ও সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক গবেষক রণদীপম বসু। এদের মধ্যে টুটুল ও তারেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। খুন ও হামলার ঘটনায় কাউকে তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা না গেলেও এসব ঘটনা উগ্র মৌলবাদী জঙ্গিরা ঘটাচ্ছে বলে গোয়েন্দারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে; আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দেশে জঙ্গী নেই; বিচ্ছিন্ন ঘটনা এগুলো। কত মুক্তমনা মেধাবী বাংলাদেশী-স্বাধীনতার পতাকাবাহী ব্লগার-কলামিস্ট-গবেষক হত্যার পরও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বলবে, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’?

উত্তরের আশায় আমরা পথ চেয়ে এগিয়ে যেতে এখন নিরব হয়ে যাচ্ছি। নিরব হয়ে যাচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চও। কেননা, নিরবে-নিভৃতে তাদেরকে ৩ ভাগে ভাগ করার রাজনীতিটাও সেরেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-ওয়ার্কার্স পার্টি-বাসদ-জাসদ আর কমিউনিষ্ট পার্টির রাজনীতিকগণ। যে কারনে দুই বিদেশি খুন; বাড্ডায় ধর্মীয় নেতা খুন; চেকপোস্টে পুলিশ হত্যা, খ্রিস্টধর্ম যাজককে হত্যার চেষ্টা এবং হোসেনি দালানে বোমা হামলার ঘটনায় দেশজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যেও সাহসী স্বাধীনতা বিরোধীচক্র। যেই গণজাগরণ মঞ্চ জামাত-শিবির-ইসলামী আন্দোলন-ইসলামী ঐক্যজোট-ইসলামী ব্যাংক-পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স-সিদ্দিকীয় পাবিলিকেশন্স-দৈনিক নয়াদিগন্ত-সংগ্রাম-কিশোর কন্ঠ-ছাত্র সংবাদ-প্রতিভা প্রকাশন-ফুলকুঁড়ি- রেনেসা কোচিংসহ সারাদেশে সহিংসতার রাসত্মায় এগিয়ে চলা দেশ বিরোধী-স্বাধীনতা বিরোধী সকল সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নিষিদ্ধের দাবীতে সোচ্চার ছিলো; তারা এখন নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য অস্তিব রক্ষায় অনঢ় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর গণজাগরণ মঞ্চের এই ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগে গড়ে তোলা হচ্ছে নৃশংস সম্মিলন। যে সম্মিলনে নিবেদিত আছে ইসলামী ব্যাংকসহ বেসরকারী ৩ টি ব্যাংক; জামাত-শিবিরসহ স্বাধীনতা বিরোধী কমপক্ষে ৭ টি সংগঠন। এই তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও খবরই রাখতে পারছে না আমাদের প্রশাসন; আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কেননা, তারাতো তাদের খবর রাখতেই ব্যস্ত সময় কাটায়; যারা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করতে করতে টাকার পাহাড় নির্মাণে ব্যস্ত। এই সুযোগে বস্নগার খুন-পুলিশ সদস্য খুন-বিদেশী খুন-ধর্মী নেতা খুনের ঘটনা বিভিন্ন মহলকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার চরমে পৌঁছে দিয়েছে; তার উপর আবার মুক্তমনা লেখকদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

সন্তানকে হত্যা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, অভিজিতের লেখা ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছে। এ কারণে হুমকি ছিল। যারা অভিজিৎকে হত্যা করেছে, সেই উগ্র মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।

অবশ্য স্বাধীনতাপ রক্ষায় অবিরত সংগ্রাম করে চলা গবেষক ও লেখক রণদীপম বসু আহতবস্থায় গণমাধ্যমকে খুবই কষ্টসাধ্য করে জানান, লালমাটিয়ার সি ব্লকের ৮/১৩ নাম্বার বাড়ির তৃতীয় তলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর অফিস। দুপুর আড়াইটার দিকে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, ইঞ্জিনিয়ার তারিক রহিম ও সুদীপ বসে কথা বলছিলেন। অফিসের প্রধান দরজা খোলা ছিল। এ সময় ৪ জন যুবক অফিসে ঢোকে। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই যুবকরা ধারালো অস্ত্র বের করে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। তারা ৩ জনই তখন হাত দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে দুর্বৃত্তদের একজন কোমর থেকে পিস্তল বের করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। পরে তারা অফিসের দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে  মোটরসাইকেলযোগে দ্রুত পালিয়ে যায়। হামলাকারীরা একজন বয়সে তরম্নণ এবং একজনের মুখে দাড়ি ছিল বলে জানান হামলার শিকার ব্যক্তিরা।

এখন কথা হলো যেখানে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে; যেখানে তাদের ক্ষমতা বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনাখুনিতে প্রায়শই মানুষ জীবন হারায়; গুলিবিদ্ধ হয় মায়ের গর্ভের সন্তান; সেখানে একটি বাড়ির ৩ তলায় উঠে প্রকাশকে গুলি করাটা খুবই আশ্চর্য জনক। কেননা, আওয়ামী লীগ আর মহাজোটের নেতাদের নির্দেশ ব্যাতিত একটি ইটও এখন আর সরতে পারে না রাজধানীতে। সেই রাজধানীতে যে সকল ঘটনা ঘটছে; সবই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের সাথে সাথে মহাজোটের শরীকদলগুলোর একটা অংশের সহযোগীতা ছিলোই; থাকতে পারে পুলিশ-প্রশাসনেরও কোন একাংশের সহযোগীতা; এভাবেই আশঙ্কা চলছে সারাদেশে। বীর শ্রেষ্ঠ আমাদের ৭ জন; বঙ্গবীর ২ জন আর মুক্তিযোদ্ধা লড়্গ লড়্গ। এই লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার দেশে সত্যি-ই স্যালুকাস যে, জনগনের অর্থ দিয়ে জনগনের বারোটা বাজাতে উঠে পড়ে লেগেছে ছাত্রশিবির-জামাত-জঙ্গী আর ইসলামী ব্যাংক। অথচ সরকার রাখছে না কোন ভূমিকা। ক্ষমতা ধরে রাখতে তৈরি হচ্ছে তারা লাশের মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়ে। তাদের মনে যদি একবারের জন্যও জনগনের কথা ভেসে উঠতো; ভেসে উঠতো মৃত মানুষগুলোর মুখ; তাহলেও আমরা দেখতাম জঙ্গী মদদদানকারী ইসলামী ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করে ব্যাংকটিকে সরকার স্বচ্ছ এবং স্বাধীনতার পড়্গে তৈরির সাথে সাথে নাম পরিবর্তন করে পিপলস ব্যাংক হিসেবে রুপান্তর করেছে; সাথে সাথে জামাত-শিবির-জঙ্গীসকল সংগঠন নিষিদ্ধও করতো। এতে করে অন্তত আমাদের বরণীয় মানুষেরা রাজনীতিকদের প্রতি আবারো ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে আসতো। যে ভালোবাসা থেকে রাজনীতিদেরকে বঞ্চিত করার সাথে সাথে ছেলে হত্যার বিচার চাওয়া থেকে সরে গেছেন অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি বলেছেন, ‘আমি এই হত্যাকান্ডের বিচার চাই না। কেননা বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক। বিচার  চেয়ে কী হবে? একজনের ফাঁসি দিয়ে কী হবে? না দিলেই বা কী হবে? হয়তো নিয়ম অনুযায়ী আমাকে একটি মামলা করতে হবে। কিন্তু এমন বিচার আমি চাই না।’ তিনি কী চান? তিনি চান নির্মমতার রাজনীতি থেকে জনগন মুক্তি পাক; দুর্নীতির করাল গ্রাসথেকে জনগন মুক্তি পাক; খুন-গুমের রাজনীতি থেকে জনগন মুক্তি পাক; স্বাধীনতা রক্ষা পাক; অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসুক এবং সম্মৃদ্ধ হোক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র জামাত-শিবির-জঙ্গীদের আস্ফালন থাকবে না; থাকবে না তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস-খুন-গুমের রাজনীতি; থাকবে না দুর্নীতি-মাদক এবং মিথ্যের বলয়; থাকবে না ধর্মের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসা ইসলামী ব্যাংকের জঙ্গী অর্থায়নের সুযোগ; থাকবে না নতুন কোন সমস্যার জাল…

মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি
আহবায়ক, ব্লগারস ক্লাব, mominmahadi@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here