ঢাকা : সরকারের একের পর এক রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে পেরে উঠছে না প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপের বিষয়ে সরকারি দলের সাম্প্রতিক বক্তব্য-প্রচারণাকে সর্বশেষ রাজনৈতিক কৌশল বা ফাঁদ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তৃতায় বলেছেন, বিএনপি অবরোধ-সহিংসতা বন্ধ এবং জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে তিনি দশম জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
সরকারি দলের একাধিক নেতা জানান, দর-কষাকষির নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে একাদশ সংসদ নির্বাচনের বেলুন আকাশে উড়িয়েছে সরকার। এর মধ্য দিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরি করে দশম সংসদ নির্বাচন শেষ করার পথ সুগম করতে যাচ্ছে সরকার, যাতে সবাই ধরে নেয় এ নির্বাচন হবেই। এর ফলে বিরোধী দল হতাশ হয়ে দ্রুততম সময়ে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপের প্রতি মনোযোগী হতে পারে বলেও সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা মনে করছেন।

কূটনৈতিক সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এই আশ্বাসকে একটি দেশ ইতিমধ্যে সমর্থন দিয়েছে। কয়েকজন কূটনীতিক আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বোঝানো হয়েছে যে নিয়ম রক্ষার জন্য নির্বাচন করতেই হবে। পরবর্তী সময়ে সমঝোতা ও সংলাপের মাধ্যমে একাদশ সংসদ নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে।

সরকারদলীয় একাধিক সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী এই বক্তব্য দেওয়ার আগে তা প্রথমে নেতাদের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছেড়ে দেন। এর আগের দিন ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, সমঝোতায় এলেও দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। এখন আলোচনা হতে পারে একাদশ সংসদ নিয়ে।
অবশ্য ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য ওই দিনই প্রত্যাখ্যান করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, জাতিসংঘের উদ্যোগে যে সংলাপ চলছে, তা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য। এটা নিয়ে সরকার বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তবে ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সরকারের অবস্থান পরিষ্কার, এখানে বিভ্রান্তির কিছু নেই। হাইকোর্টের রায় এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামায়াত নিবন্ধিত দল নয়। তাকে সঙ্গে রাখার সুযোগ বিএনপির নেই।

সরকারদলীয় একাধিক সূত্র বলছে, সরকারের এখনকার কৌশল হচ্ছে জামায়াতকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করা। নির্বাচনের আগেই দেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় জামায়াতকে শক্তিহীন ও দমন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। এরপর ৫ জানুয়ারি নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগ সহযোগী সংগঠনগুলোকে নিয়ে নতুন উদ্যমে মাঠে নামবে।

আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা বলেন, মাত্র ৩ শতাংশেরও কম ভোটার থাকা একটি দলের কাছে জাতি জিম্মি থাকতে পারে না। নির্বাচনের পর সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াত-শিবিরকে পাল্টা জবাব দেওয়া হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর আগে দুই নেত্রীর মধ্যে টেলিফোনে কথোপকথনের বিষয়টি নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া রাজনৈতিক ফাঁদে পড়েছিলেন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি, এমন কথাই প্রচার পায় বেশি। বিদেশিরাও এই প্রচারকে আমলে নেন। কথোপকথনের রেকর্ড প্রকাশ করা হলে তাতে খালেদা জিয়ার ক্ষোভ এবং অনমনীয় মনোভাবের কথাই মানুষ বেশি জানতে পারে।
তবে এ দেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের বেশির ভাগই মনে করেন, বাংলাদেশের দুই নেত্রীই একে অপরকে শাস্তি দিতে চান। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, সন্তানদের বিদেশে পাঠানো, নিজের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা, দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা-মামলার ঘটনায় খালেদা জিয়া সবার আগে প্রধানমন্ত্রীকেই শাস্তি দিতে চান। তিক্ত পরিস্থিতিতে ক্ষমতা ছাড়ার পর জনগণের সহানুভূতি যাতে প্রধানমন্ত্রীর ওপর না থাকে তেমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করাই প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার লক্ষ্য।

এসব কূটনীতিক এটাও বিশ্বাস করেন, পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরে যাওয়ায় সরকার তার জনপ্রিয়তা আঁচ করতে পারে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাননি বিরোধী দল নির্বাচনে আসুক। তিনি সংলাপ ও আলোচনার মারপ্যাঁচে খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে নানা কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর, তা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে মোকাবিলা করতে পারেনি বিএনপি।
আবার এটাও ঠিক, টানা অবরোধ কর্মসূচি ও সহিংস পরিস্থিতির কারণে বিরোধী দল ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। আবার সরকারও পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থানের কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দুই দলের ওপরই মানুষ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। তাঁদের মতে, সংলাপ নিয়ে যা কিছু হয়েছে তাতে বিরোধী দলের চেয়ে সরকারই সুফল পেয়েছে বেশি। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো সরকারি দলের ওপর কোনো রকম চাপ সৃষ্টি করতে পারেননি। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলে সরকার একতরফা নির্বাচনের পথে এগিয়ে গেছে।

অন্যদিকে নির্বাচনের তারিখ পেছানো যায় কি না, তারানকো তা ভেবে দেখার অনুরোধ জানালেও প্রসঙ্গটি কৌশলে এড়িয়ে গেছে সরকার। নির্বাচন পেছানোর বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের—এমন অজুহাত দেখিয়ে সরকার নিজের অবস্থানে অনড় থাকে। যদিও নির্বাচন কমিশন বলেছে, সমঝোতা না হলে নির্বাচন পিছিয়েও লাভ নেই।

অবশ্য বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, যে সংলাপ শুরু হয়েছিল বর্তমান নির্বাচন ঘিরে, তা এখন গুরুত্বহীন। ঢাকার বাইরে কোথাও এখন আর সরকার নেই। তিনি দাবি করেন, এভাবে চলতে থাকলে সরকার নিজেই তার ফাঁদে পড়বে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণের ঘটনা সরকারের জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পাকিস্তানের এই নিন্দনীয় ভূমিকার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবার মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। পাকিস্তানের ওই অবস্থানের বিষয়ে বিএনপি চুপ থাকায় সরকারি দলের নেতারা বিএনপিকে আরেক দফা ঘায়েল করার সুযোগ পেয়েছেন।

সার্বিক অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে অন্য দল থেকে মনোনীত প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক যে খেলা চলছে তার নিয়ন্ত্রণ পুরোটা সরকারের কাছে নেই। যারা খেলছে তারাই এর ভবিষ্যৎ বলতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত খেলার মাঠ সরকারের দখলে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।- প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here