গুলসান ডিসিসিষ্টাফ রিপোর্টার :: গুলশানে ধসে যাওয়া ডিসিসি মার্কেটের প্রথম গলিতে ‘সাইকা ইন্টারন্যাশনাল’ নামে দুটি দোকান ছিল মো. আনোয়ার হোসেন সুমনের। রাজধানীর বেশির ভাগ নামিদামি সুপার শপের কাছে এ দোকান থেকে তিনি শিশুখাদ্যসহ বেশ কিছু ব্র্যান্ডের উপকরণ পাইকারি বিক্রি করতেন।

বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এ দোকান পেয়েছিলেন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার যখন দেখা হয় তখন হাউমাউ করে কাঁদছিলেন সুমন। বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আগে বাবা মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে দোকান বরাদ্দ নিয়েছিল। বাবার পর আমি ব্যবসার হাল ধরেছি। রাজধানীর বড় বড় সুপার শপে আমার দোকান থেকে পণ্য সরবরাহ করা হতো। দুই দিন আগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কাল (সোমবার) রাতে আগুনের খবর শুনে ছুটে এসেছি। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে দোকান দুটি। সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার মালামাল ছাই হয়ে গেছে। ’

সোমবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ডিসিসি কাঁচাবাজার মার্কেটের সাড়ে তিনতলা ভবনটি মুহূর্তেই ধসে যায়। সেখানে ছিল প্রায় ৪০০ দোকান। এসব দোকানের মালিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ভ্যানচালকসহ প্রায় ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান ছিল। অগ্নিকাণ্ড প্রায় সবাইকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আগের রাতেও যাঁরা কোটিপতি ব্যবসায়ী ছিলেন, সকাল না হতে সেই তাঁরাই ফকির হয়ে গেলেন।

মার্কেটের নিচতলায় ১০৫ ও ১০৬ নম্বরে ছিল ‘ভাই ভাই টাওয়াল’ নামের দোকান, মালিক হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘ছেলের স্কুল বন্ধ থাকায় কিশোরগঞ্জে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আগুনের খবর পেয়ে ছুটে আসি। শত চেষ্টা করে এক টাকার মালও বের করতে পারিনি। ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে। আমাদের পরিবারের পক্ষে আর উঠে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। ’

মার্কেটে ‘নোয়াখালী বানিয়াদী স্টোর’ নামের দোকানটির মালিক ফকির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বছরের শুরুতে ১০ লাখ টাকার মালামাল দোকানে নিয়ে এসেছি। দোকানের পাশে একটি গোডাউনে রাখা ছিল সেই মাল। চকবাজারের এক পাইকারকে দেওয়ার জন্য নগদ সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দোকানে রেখেছিলাম। বাসা থেকেও দোকানকেই বেশি নিরাপদ মনে করেছিলাম। আগুনের খবর শুনে দ্রুত এসেও কিছু করতে পারিনি। আশা ছিল, ঝুঁকি নিয়ে হলেও নগদ টাকা বের করতে পারব; তাও পারিনি। কম করে হলেও ৫০ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। ’ কথাগুলো বলার সময় চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারলেন না। পাশে থাকা অন্য ব্যবসায়ী তাঁর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। লাভ হলো না। উল্টো একপর্যায়ে উভয়েই কাঁদতে শুরু করলেন।

এক দিন আগেও যেখানে কোটি টাকার মালামালসহ সুসজ্জিত দোকানপাট ছিল, সেখানে এখন কেবল ধ্বংসের চিহ্ন। ক্ষতির শিকার ব্যবসায়ীদের চোখেমুখে হাহাকারের ছাপ। নিজেদের রুটি-রুজির অবলম্বনটি পুড়ে যাওয়ার খবর শুনে পরিবারের অন্য সদস্যরাও ছুটে এসেছিল। একে অপরকে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে গেল তারা। সহ্য করতে না পেরে বুকভরা কষ্ট নিয়ে একসময় ঘটনাস্থল ছাড়ে অনেকে।

গতকাল দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন আগুন নেভানোর জোর চেষ্টা করছিলেন তখন মার্কেটের সামনের ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্যবসায়ী ইউসুফ, নুরুন্নবী ও শরিফুল। মার্কেটের নিচতলায় তাঁদের ফলের দোকান ছিল। ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, ‘যা ছিল সব শেষ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বলে আর কী হবে? দোকানই ছিল আমাদের সংসার চালানোর হাতিয়ার। ’

কাঁচাবাজারের গা ঘেঁষে থাকা দোতলা ডিসিসি পাকা মার্কেটটি ধসে যায়নি, তবে আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ২৩৪টি দোকানের মধ্যে কিছু মালামাল বের করে নিয়ে আসতে পারলেও বাকি সব পুড়ে গেছে। রাজধানীর সব মহলের কাছে পরিচিত এ মার্কেটে অনেক মূল্যবান পণ্যের দোকানও ছিল। একেকটি পণ্যের দাম কয়েক লাখ টাকা, এমন পণ্যও ছিল।

স্থানীয় সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ বললেন, ‘এখানে কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়ী রয়েছেন। একটি স্বর্ণের দোকানের জামানত আছে তিন কোটি টাকা। আর মালামাল তো অনেক টাকার। তাই এ অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে অল্পস্বল্প ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ নেই। ’

মার্কেটের বেলাল ক্রোকারিজের মালিক বেলাল হোসেন বললেন, ‘আগুনে দোকানে থাকা সব মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে প্রায় কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে। ’

‘কোলন অ্যান্ড কটন’ নামের দোকানের মালিক আখতারুজ্জামান জানালেন, আগুনে দোকানের প্রায় দেড় কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে এসে দেখি ফায়ার সার্ভিসের চার থেকে পাঁচটি ইউনিট রয়েছে। অথচ তারা বলছে ২৪টি ইউনিট কাজ করছে। পাশের মার্কেটে যতটুকু আগুন লেগেছিল তা প্রাথমিক অবস্থায় নেভানোর কাজ করলে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না। ’

গুলশান ডিসিসি পাকা সুপারমার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি তালাল রিজভী বলেন, ‘আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের চরম গাফিলতি রয়েছে। আমাদের মার্কেটের পাশে দুটি লেক রয়েছে। তারা সেখান থেকে দ্রুত পানি নিয়ে আসতে পারত। আমি রাতে আগুন লাগার খবর পেয়ে ভয়াবহতা উল্লেখ করে বেশি ইউনিট পাঠানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসকে বলেছি। কিন্তু তারা প্রথমে মাত্র দুটি ইউনিট পাঠিয়েছে। ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬০০-এর ওপরে দোকান পুড়েছে। ’

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘মার্কেটের আশপাশে পানি না থাকায় প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এক কিলোমিটার দূর থেকে পাঁচটি লাইন দিয়ে পানি এনে তা সরবরাহ করা হচ্ছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কোনো গাফিলতি নেই। ’

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা চাই তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত এ আগুনের বিষয়টি পরিষ্কার হোক। অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুনরায় ব্যবসা চালু করতে তাদের সব ধরনের সহায়তা করার দাবি জানাচ্ছি। ’

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here