আত্মস্খলনের দায় : ৩
ফরিদ আহমদ দুলাল
যে কোনো কাজের পুরস্কার, সে কাজের এক ধরনের স্বীকৃতিও। পুরস্কার প্রাপ্তিতে নিশ্চয় এক ধরনের প্রেরণাও থাকে। তা না হলে বিশ্বব্যাপী পুরস্কার প্রদানের প্রথা প্রচলিত আছে কেন। তবে সব পুরস্কারের মান ও সম্মান সমান নয়। পুরস্কারের মান সবসময়ই যে অর্থমূল্যে নির্ধারিত হয় তা-ও নয়। বাংলাদেশেও সাহিত্য ক্ষেত্রে এমন অনেক পুরস্কার আছে যার অর্থমূল্য আমাদের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘একুশে পদক’ অথবা ‘স্বাধীনতা পদক’-এর চেয়ে দ্বিগুণ-চারগুণ-অথবা তারও বেশি; কিন্তু জাতির কাছে সেগুলো কিছুতেই অতটা সম্মানের নয় যতটা সম্মানের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘একুশে পদক’ অথবা ‘স্বাধীনতা পদক’। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এগুলোর সম্মান অন্যদের তুলনায় বেশি, সেটি বুঝতে হবে; বুঝতে হবে সব পক্ষকেই; বিশেষভাবে যারা পুরস্কার প্রাপকদের নামের তালিকা প্রস্তুত করেন, যারা তালিকা চূড়ান্ত করেন সবারই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। তা না হলে যে কোনো পুরস্কারের মানই পড়ে যেতে পারে। বাংলা একাডেমি প্রদত্ত সাহিত্য পুরস্কারের কথাই ধরা যাক, সম্মানজনক এ পুরস্কারটি কি আগের মত সম্মানের জায়গায় আছে? সহজ উত্তর, নেই। কেন নেই সে প্রশ্নের উত্তরও সবার জানা। যারা পুরস্কার প্রদানের সাথে সম্পৃক্ত তাদের যদি কাণ্ডজ্ঞান না থাকে, যদি যে বিষয়ে পুরস্কার দেয়া হয়, সে বিষয়ে সম্মক ধারনা না থাকে, যদি তাদের জ্ঞান-প্রজ্ঞার ঘাটতি থাকে, তাদের মধ্যে যদি সততা-নিষ্ঠার অভাব থাকে; কীভাবে আমরা আশা করতে পারি, পুরস্কারটি যোগ্যতর মানুষের হাতে যাবে? যাবে যে না তার উদাহরণ আমাদের হাতে ভুরিভুরি রয়ে গেছে।
আর আমরা যারা পুরস্কার পাই তাদের বিবেচনায়ও নানান বৈচিত্র্য দেখতে পাই। উদ্ভট সব আচরণ তাদের মধ্যে দেখতে পাই। বানরের গলায় মুক্তোর মালা পরালেও বানর বানরই থাকে, মুক্তোদানাগুলোরই অপচয় হয়; এ বোধটি সব পক্ষেরই হৃদয়ঙ্গম করা আবশ্যক। পুরস্কারের আলোয় আলোকিত যারা, তারা ভাগ্যবান ভিআইপি মর্যাদা পান, তাদেরও দেখি বাঘ-সিংহ শিকারের পর খাটাশ-খরগোশ শিকারের কাহিনি লেখেন! যিনি এমএ পাশ করেন তাকে কেনো প্রাইমারি পাশের পরীক্ষা দিতে হয়? যিনি স্বাধীনতা পদক-একুশে পদক অথবা বাংলা একাডেমি পদক পান তিনি কেনো ছোট খাটো অনামী পদক-পুরস্কারের জন্য হ্যাংলামো করবেন? “স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে;/ পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি/ ধুলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে/ কে তুমি? জনম তব কোন মহাকুলে?/ কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে;/ যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,/ শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,/ কবে, হে বীরকেশরী, সম্ভাষে শৃগালে/ মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,/ অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।”
পুরস্কার পাওয়ার জন্য আমাদের আকুলতা থাকুক, কিন্তু সে আকুলতা যেনো কলুষিত না হয়ে যায় সে বিবেচনাটি আমাদের প্রত্যেকেরই থাকা উচিত। আর যারা পুরস্কার প্রদান প্রক্রিয়ায় যুক্ত তারা দয়া করে এমন কিছু করবেন না যাতে আগামীতে আপনার দেয়া পুরস্কারটি পাওয়ার আকুলতা আমার কমে যায়। আমার ধারনা বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তির আকুলতায় ইতোমধ্যেই যথেষ্ট ভাটা পড়েছে। দয়া করে এটিকে আর নিচে নামাবেন না। সম্মানজনক এ পুরস্কারের সম্মানটি সমুন্নত রাখুন, আমাদের জন্য একটা আশ্রয় তো থাকতে দিন।
একজন আত্মহত্যা করবার ভয় দেখালো, আর আপনি তাকে ভয়ে পুরস্কার দিয়ে দিলেন; একজন আপনাকে গালিগালাজ করলো, আর আপনি ভয়ে তাকে পুরস্কার দিয়ে দিলেন; একজন আপনাকে ‘ব্লু-ল্যাভেল’ পাঠালো আর আপনি তাকে পুরস্কার দিয়ে দিলেন; যমুনার লাল রুই পাঠালো একজন, আর আপনি তাকে পুরস্কার দিয়ে দিলেন; একজন হাত-পা ছুড়ে কান্না জুড়লো, আর আপনি তাকে পুরস্কার দিয়ে দিলেন; ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা বলে একজন আবদার করলো, আহ্লাদে গদগদ হয়ে আপনি তাকে পুরস্কারের মালা পরিয়ে দিলেন; কেনো এমনটি করতে হবে? বাংলা একাডেমি আমাদের চেতনার প্রতিষ্ঠান, এর সম্মান দয়া করে নষ্ট করবেন না!
আসুন আমরা সবাই মিলে বাংলা একাডেমির মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সম্মান সমুন্নত রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই!
(চলবে……)
লেখকের ই-মেইলঃ swatantro@yahoo.com