মিলন কর্মকার রাজু , কলাপাড়া(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি :: মাত্র ১২ দিনের আই সি টি প্রশিক্ষণ পেয়েছেন শিক্ষক মো. সোহেল মিয়া। এই প্রশিক্ষণ পেয়ে শুধু ল্যাপটপ অন ও অফ করা ছাড়া কিছু ফাইল এবং ফোল্ডার খোলা শিখেছেন। কিন্তু তাঁর উপর দায়িত্ব দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল শিক্ষা কন্টেন্ট (বিষয়বস্তু) তৈরি করে পাঠ্য পুস্তকের ধারণাসমূহ আরোও আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করে শেখানো। এজন্য শিক্ষা অফিস থেকে গত বছর ডিসেম্বর মাসে বিদ্যালয়ে একটি ল্যাপটপও দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেয়া হয়নি প্রজেক্টর। এ কারণে কন্টেন্ট তৈরিতো দূরের কথা গত দুই মাসেও কিছুই শেখানো হয়নি শিক্ষার্থীদের।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার দক্ষিন দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ডিজিটাল শিক্ষার চিত্র এটি। একই চিত্র উপজেলার ৯০ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।
কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে জানা যায়,উপজেলার ৭১টি প্রাথমিকে গত বছর ডিসেম্বর মাসে ল্যাপটপ বিতরণ করা হয়েছে। আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির সাথে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পরিচিত করানোসহ শিক্ষামূলক কন্টেন্টসমূহ শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠ্যবিষয়কে সহজ এবং শিখন-শেখানো প্রক্রিয়াকে অংশগ্রহণমূলক, আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক করাই এর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু শুধু ল্যাপটপ বিতরণ করলেও বিষয়বস্তু প্রদর্শণের জণ্য প্রজেক্টর সরবরাহ করা হয়নি। করা হয়নি মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম। এ কারণে শুধু নামেই শিক্ষা ডিজিটালকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলেও খোদ ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরিতে এখনও অন্ধকারে রয়েছে উপকূলের অধিকাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
কলাপাড়ার একাধিক বিদ্যালয় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কোন বিদ্যালয় টিনসেড, অর্ধভঙ্গ। কোন বিদ্যালয় আলীশান দ্বিতল ভবন, অথচ ছাত্র-ছাত্রী নামমাত্র। কোন বিদ্যালয়ের ভবন জরাজীর্ণ । আবার একাধিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি তিন-চারশ ছাড়িয়ে এখন তাদের ক্লাস রুম সংকট। এসব বিদ্যালয়ের অধিকাংশেরই নেই বিদ্যুত সংযোগ। শিক্ষক সংকটের সাথে রয়েছে বসার বেঞ্চ, টেবিল সংকট। কোন কোন বিদ্যালয়ে অফিস রুম থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র।
গ্রামীন জনপদে শিক্ষার হার বাড়ার গ্রাফ ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও আধুনিক শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম না থাকা, শিক্ষকদের কম্পিউটার-ল্যাপটপ অপারেটিং না জানা এবং ধারণা না থাকায় বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ বাস্তবায়ন কর্মসূচী চলছে শম্ভুক গতিতে।
এক তথ্যে জানা যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের (প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি) আলোকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ক ইন্টারঅ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল শিক্ষা কন্টেন্ট তৈরি ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপস্থাপন এই ডিজিটাল শিক্ষা কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য। পাঠ্যপুস্তকের ধারণাসমূহ আরো আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করতে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ছবি, চার্ট, ডায়াগ্রাম, অডিও, ভিডিও সহ মাল্টিমিডিয়া উপকরণসমূহ সংযোজন করে এ্যানিমেশনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
বিষয়ভিক্তিক শিক্ষক, প্রশিক্ষক, প্যাডাগোজি বিশেষজ্ঞ, এডুকেশন সেক্টর বিশেষজ্ঞ, চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, কালার, প্রোগ্রামিং ও এনিমেশন বিশেষজ্ঞদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে প্রতিটি অধ্যায়ের কাংখিত শিখনফলের আলোকে এই ডিজিটাল শিক্ষা কন্টেন্টসমূহ প্রস্তুত করা হয়েছে। বিদ্যালয়ে শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তোলাই এই ডিজিটাল শিক্ষা কন্টেন্ট এর মূল উদ্দেশ্য।
এতে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ্য বিদ্যার পরিবর্তে বিকশিত চিস্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি এবং অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী হয়ে উঠবে। কিন্তু উপকূলের বিদ্যালয়গুলোতে এ ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম চলছে কাগজে কলমে।
নদী ভাঙ্গন কবলিত পটুয়াখালীর কলাপাড়ার চম্পাপুর ইউনিয়ন। আগুনমুখা নদীর গ্রাসে গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোও ভিটে,চাষের জমি হারিয়ে এখন সহায় সম্বলহীন। নদী,সাগরে মাছ ধরা ও শ্রম বিক্রি করে এখানকার ৭০ ভাগ মানুষের পেশা। তারা প্রতিদিন দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানবেতর জীবনযাপন করছে। গ্রামের ৩৫-৪৫ উর্ধ্ব বেশিরভাগ মানুষই শুধু অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন কিংবা টিপসই জানা। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলোর সন্তানরা এখন স্কুলমুখী হচ্ছে। কিন্তু এখানকার নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত এই ডিজিটাল শিক্ষা কর্মসূচী থেকে।
দক্ষিন দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোসাঃ মেহেরুন্নেছা জানান, ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ২০৫ জন। গত বছর শিক্ষার্থী ছিলো ২৩১ জন। এ বছর সমাপনী পরীক্ষায় ১৯ জন অংশ নিয়ে ১৬ জন পাশ করেছে। বিদ্যালয়ের আধুনিক ভবন বিদ্যুত সুবিধা সবই আছে। কিন্তু তাঁরা অন্ধকারে ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম থেকে। তিঁনি জানান, বিদ্যালয়ের পাকাভবন থাকলেও নেই ডিজিটাল ক্লাস রুম। দেড় বছর আগে সহকারি শিক্ষক মো. সোহেল মিয়া ১২ দিনের আই সি টি প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কিন্তু দুই মাস আগে পেয়েছেন ল্যাপটপ। এখনও পান নি প্রজেক্টর। তাহলে কন্টেন্ট তৈরি করে শিশুদের কি শেখাবেন তিনি ?
আই সি টি প্রশিক্ষণ নেয়া শিক্ষক মো. সোহেল মিয়া জানান, যা শিখছি তা প্রাকটিস করতে না পেরে এখন ভুলে গেছি। তাছাড়া ল্যাপটপ পেলেও প্রজেক্টর পাইনি। তাহলে শিক্ষার্থীদের কি শেখাবো।
এ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মোসাঃ শারমিন ( রোল নং ১) জানায়, “ স্কুলে ল্যাপটপ পাইছে দেখছি। কিন্তু হেইডা দিয়া আমাগো এ্যাহনও পড়ায় নায়। এইডা (ল্যাপটপ) দিয়া আমরা ছবি দেইখ্যা পড়তে পাড়মু স্যারেরা কইছে। কিন্তু সব মেশিন (প্রজেক্টর) এখনও স্কুলে না পাওয়ায় আমাগো ডিজিটাল ক্লাস শুরু হয়নি।”
একই বিদ্যালয়ের ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার (রোল নং ২) জানায়, “ছবি দেইখ্যা ল্যাহাপড়া শিখাইলে পড়ালেখা খুব সহজে মুকস্থ্য হয়। মনে থাহে। আমরা ক্লাস ফাইভে পড়ি কিন্তু এ্যাহনও এই ক্লাস করতে পারি নাই।” একই কথা বলেন উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
লালুয়া ইউনিয়নের লালুয়া বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ জানান, বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষকই আই সি টি প্রশিক্ষণ পায়নি। অথচ বিদ্যালয়ে ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম চালুর জন্য একটি ল্যাপটপ দেয়া হলেও প্রজেক্টর দেয়া হয়নি। আর ল্যাপটপ অপারেটিং না জানায় তাঁরা কিভাবে ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এ নিয়ে চিন্তিত।
চাড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহিরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী এ বছর ভর্তি হয়েছে। তিনিও গত বছর ল্যাপটপ পেয়েছেন। নিজে কিছু কন্টেন্ট তৈরি করেছেন। কিন্তু প্রজেক্টরের অভাবে তা প্রদর্শণ করতে পারছেন না।
ধুলাসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান জানান, বিদ্যালয়ের আধুনিক ভবন, বিদ্যুত সুবিধা সবই আছে। আই সি টি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকও আছেন। কিন্তু প্রজেক্টরের অভাবে ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পারছেন না।
উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ চিত্র থাকলেও বিপরীত চিত্র শহর কেন্দ্রিীক। কলাপাড়ার মংগলসুখ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল হোসেন জানান, ২০১০ সালে সরকার কর্তৃক ল্যাপটপ পাওয়ার পর থেকে শিক্ষামূলক বিভিন্ন কন্টেন্ট তৈরি করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়া হচ্ছে যাতে ছবি দেখে তারা সহজেই মনে রাখতে পারে বিষয় বস্তু।
গ্রামীন জনপদের প্রত্যন্ত এলাকা ক্রমশ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে। এখন প্রথ্যন্ত এলাকায় কিন্ডার গার্টেনসহ আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও শুরু হয়ে গেছে আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রতিযোগীতা। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে সব সুবিধাই বিদ্যমান থাকা সত্বেও সঠিক সময়ে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
একাধিক অভিভাবক জানান, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুতায়ন ও প্রযুক্তি প্রত্যন্ত এলাকার প্রতিটি মানুষের হাতে। ঘরে বসেই তারা টিভির সংবাদ শোনাসহ সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে সরাসরি দেখতে পারছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখতে পারছে খুব সহজেই। তাই গ্রামের মানুষও চায় তাদের সন্তান ভালো স্কুলে পড়ুক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। কিন্তু স্কুলগুলোতে সেই মান্দাতা আমলের ষ্টাইলেই পড়াচ্ছে। তাই সরকারি ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত প্রতিটি স্কুলে চালু করা উচিত।
এ ব্যাপারে কলাপাড়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ এর ইতিহাস বিভাগ এর প্রভাষক নেছারউদ্দিন আহমেদ টিপু বলেন, বর্তমান সরকার শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জণ্য প্রাথমিক স্থরে যে ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। শহর কেন্দ্রীক এ ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলেও কিন্তু গ্রামীন জনপদের শিক্ষার্থীরা এ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে শৈশবেই প্রত্যন্ত জনপদের শিক্ষার্থীরা আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়ছে। শহরের মতো গ্রামের প্রতিটি বিদ্যালয়ে দ্রুত এই ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা উচিত। এজন্য শিক্ষকদের আই সি টি বিষয়ে আরও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে বলে তিঁনি জানান।
কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনি লাল সিকদার বলেন, সরকার প্রতিটি স্কুলই আধুনিকায়নের উদ্যেগ নিয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি স্কুলে ডিজিটাল ক্লাসরুমকরা এবং স্কুলগুলোতে প্রজেক্টর সরবরাহ করা হবে। এছাড়া যেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখনও আই সি টি প্রশিক্ষণ পায়নি তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।(চলবে)