উপকূলের শিক্ষামিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি :: স্কুলে পড়তে হলে কোচিং বাধ্যতামূলক। কোচিং ক্লাস না করলে বিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্লাসে শ্রেণি শিক্ষকদের রোষানলে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক এমনকি কিন্ডার গার্টেন শিক্ষার্থীদেরও কোচিং বাধ্যতামূলক করেছে অধিকাংশ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকরা। কোচিং করলেই পাশ এই মন্ত্র ছড়িয়ে অভিভাবকদের একরকম ইচ্ছার বিরুদ্ধে সন্তানদের কোচিং ক্লাসে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মডেল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষকরা এখন বিদ্যালয়ে পড়ানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে এই কোচিং ক্লাস। শিক্ষা অফিস থেকে কয়েক মিনিট দূরত্বে চারিদিকে প্রকাশ্যে এই কোচিং বানিজ্য চললেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।

কলাপাড়া মংগলসুখ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয় থেকে এবার পিএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় ৯৩ শিক্ষার্থী। এ শিক্ষার্থীরা সবাই বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ক্লাস ছাড়াও অধিকাংশ শিক্ষার্থীই শিক্ষকদের পরিচালিত কোচিং ক্লাসের শিক্ষার্থী ছিলো। কিন্তু পাশ করেছে ৭৩ জন। শুধু পঞ্চম শ্রেণিতেই এই মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফেল করেছে ২০ শিক্ষার্থী। এই বিদ্যালয়ে গত বছর চারশ ৮৬ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক ১৬ জন। প্রতি ৩০ঃ৩৭ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ছিলো একজন শিক্ষক।

বিপরীত চিত্র চরাঞ্চলের ধুলাসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পরীক্ষায় ৭৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে ছয় জন জিপিএ-৫সহ শতভাগ পাশ করে। অথচ এ বিদ্যালয়ে সাত জন শিক্ষকের পদ থাকলেও প্রধান শিক্ষকসহ দুই শিক্ষকের পদ শূণ্য। গত বছর চারশ তিন জন শিক্ষার্থীকে পাঁচ শিক্ষক ক্লাস নেয়। প্রতি ৮০ঃ৬ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক এ বিদ্যালয়ে।

উপজেলা সদর ও গ্রামের এই দুটি বিদ্যালয় পরিসংখ্যান এবার সচেতন অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুললেও উপজেলা শিক্ষা অফিস কিংবা মডেল স্কুলের শিক্ষকরা এই ফেলের পরিসংখ্যান নিয়ে ভাবছেন না। কলাপাড়া মংগলসুখ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোটা বিষয়টি পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত শিক্ষকদের অতিমাত্রায় কড়াকড়ি ও সিট প্লান নিয়ে ঝামেলাকে দায়ী করেছেন। তিঁনি বলেন, তারা অভিভাবকদের কারনে নিজ বাসায় কোচিং করান, কাউকে বাধ্য করিয়ে পড়ান না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কলাপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোপনে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের কোচিংবাজ ২৩ শিক্ষককের নাম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল শিক্ষকদের কোচিং বানিজ্য বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অফিস থেকে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছেই না। বরং তারা বিষয়টি জানেন না বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন।

কলাপাড়া পৌর শহরের এক নং ওয়ার্ড থেকে নয় নং ওয়ার্ড পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। যার অধিকাংশের শিক্ষক উপজেলার বিভিন্ন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা। এমনকি শহরের বিভিন্ন স্পটে বাসা ভাড়া নিয়ে এই শিক্ষকরা গড়ে তুলেছে তাঁদের এই কোচিং বানিজ্যের নামে অভিভাবকদের পকেট কাটার ব্যবসা। এই কোচিং ক্লাসে পড়লেই পাশ, না পড়লে ফেল এই ভীতি ছড়িয়ে সকল শিক্ষার্থীকে কোচিং ক্লাসে যেতে বাধ্য করে। গত বছর ছিলো তাঁদের কোচিং বানিজ্যের মেীসুম। এ বছরও স্কুলে বই বিতরণের সাথে সাথে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই কোচিং সেন্টার চালু করেছে।

একাধিক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “স্কুলে স্যারেরা, আপারা ধরলে কি করমু। হ্যারাতো কয় কোচিং করতেই হইবে। আবার সরকার কয় (টিভিতে দেখে) কোচিং বন্ধ। আমরা কোনডা হুনমু। পোলাপান স্কুলে পড়লে হ্যাগো (শিক্ষক) কথা না হুনলে তো ক্লাসে মন্দ কয়। কোচিংয়ে যাইতেই হইবে কয়। বাধ্য হইয়া ধার কর্জ কইর‌্যাও পোলামাইয়া কোচিংয়ে পাঠাই।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, একজন শিক্ষক গড়ে ৪০-৮০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে কোচিং করান। প্রতি শিক্ষার্থীর বেতন ৭০০-১০০০ টাকা (ক্লাস অনুসারে)। সেই হিসেবে যদি ১১ মাস কোচিং ক্লাস নেন তাহলে ছাত্র-প্রতি সাত হাজার ৭০০ থেকে ১১ হাজার টাকা বেতন নেন। তাহলে ১১ মাসে ওই কোচিং সেন্টার থেকে তাঁর উপার্জন ৪০ জন ছাত্র হলে সাতশ টাকা বেতন হলে তিন লাখ আট হাজার, এক হাজার টাকা বেতন হলে চার লাখ টাকা।

আবার ৮০ জন শিক্ষার্থী হলে তাঁর উপার্জণ ছয় লাখ ১৬ হাজার টাকা (মাসিক সাতশ টাকা বেতন), এক হাজার টাকা বেতন হলে আট লাখ টাকা। উপজেলার অন্তত দুই শতাধিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এই কোচিং ব্যবসা করে গোটা উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে জিম্মি করে রেখেছে।

এছাড়াও শিক্ষকদের আরও কোচিং ব্যবসা রয়েছে স্থানীয় ভাষায় এটাকে “হোম বিজনেস” আখ্যা দিয়েছে অভিভাবকরা। এই শিক্ষকরা এই হোম বিজনেসে প্রতি ছাত্র-ছাত্রীকে (৪৫-৬০ মিনিট) পড়িয়ে দুই হাজার টাকা থেকে তিন হাজার টাকা নিচ্ছেন। বিদ্যালয়ের গনিত, ইংরেজি, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, জীব বিজ্ঞান, উচ্চতর গনিত, বাংলা বিষয়ের শিক্ষকরা এই হোম বিজনেসের সাথে জড়িত।

তবে সাংবাদিকরা এই বিষয়টি শিক্ষকদের কাছে জানতে চ্ইালে অধিকাংশ শিক্ষক নিজেকে উদার দাবি করে বলেন, “ আমরা কোচিং করাই না। অভিভাবকরাই আমাদের বলে তাদের সন্তানদের পড়াতে। কেউ দেয় কোচিং ক্লাসে, কেউ বলে বাসায় গিয়ে পড়াতে। এখন অভিভাবকরা আমাদের বাধ্য করলে কি করার আছে। আর সব শিক্ষকই চায় ছাত্র-ছাত্রীরা ভালো ফলাফল করুক”। তবে অনেক গরীব শিক্ষার্থীকে ফ্রিতে পড়ানো হয় বলে একাধিক শিক্ষক জানান।

কলাপাড়ার ধুলাসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান জানান, তাদের বিদ্যালয়ে এমনিতেই শিক্ষক সংকট। এ কারনে অনেক দূর্বল (পড়াশোনায় পিছিয়ে) শিক্ষার্থীকে ভালো ফলাফলের জন্য বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া হয়। এটা কোচিং ক্লাস না আর এখানে কোন নির্দিষ্ট বেতনও নেই। তারপরও তারা বিদ্যালয় ভালো ফলাফল করেছে। এটা হয়েছে শিক্ষকদের আন্তরিকতায়।

কলাপাড়া মংগলসুখ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল হোসেন বলেন, ক্লাস শেষ হওয়ার পর তিনিসহ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বাসায় কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে গত বছর পড়াতেন। তবে ক্লাসের বাইরে সরকারের কোচিং করার কোন বাধা নেই বলে জানান। তবে অভিভাবকদের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি কোচিং ব্যবসার সাথে জড়িত এই বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা।

কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনি লাল সিকদার জানান, প্রাথমিক শিক্ষকরা কেউ কোচিং ক্লাসের সাথে জড়িত এই বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তবে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহিদ হোসেন জানান, গত বছর কোচিংবাজ ২৩ শিক্ষকের তালিকা করে সংশ্লিস্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে কোচিং ব্যবসার সাথে জড়িত সকল শিক্ষকের তালিকা করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান।(চলবে)

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here