01.-Sodesh-সেদিন দুপুরে তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। সেদিন রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য।

বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা।

পূর্বপশ্চিমের পাঠেকের জন্য বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষনটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

‘আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সেপাই, সৈনিক, জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।

আমার বাংলা স্বাধীন থাকবে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মেয়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী তারা সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসির কাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না।

আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হবেই। আমি আমার যেই ভায়েরা যারা আত্মাহুতি দিয়েছে, শহীদ হয়েছে তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আজ প্রায় ত্রিশ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দেয়া হয়েছে বাংলার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এবং প্রথম মহাযুদ্ধেও এত লোক, এত সাধারণ নাগরিক মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই। যা আমার এই সাত কোটির বাংলাদেশে হয়েছে। আমি জানতাম না আপনাদের কাছে আমি ফিরে আসব। তাই খালি একটা কথা বলেছিলাম। তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও আমার আপত্তি নাই। মৃত্যুর পর আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও। এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।

আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধিকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনসাধারণকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে। আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনসাধারণকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ব্রিটিশ, জার্মানি, ফ্রান্স সব জায়গায় যে গভর্নমেন্ট জনসাধারণ আছে, তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই যারা আমাকে সমর্থন করেছে। আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে। আমি মোবারকবাদ জানাই দুনিয়ার মজলুম জনসাধারণকে যারা আমার এই মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করেছে।

image_569_123397আমার বলতে হয়, এক কোটি লোক এই বাংলাদেশের থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের জনসাধারণ, মিসেস ইন্দিরা গান্ধি তাদের খাবার দিয়েছে। তাদেরকে মোবারকবাদ জানাতে পারি নাই। যারা অন্যরা সাহায্য করেছে তাদেরকেও মোবারকবাদ দিতে হয়।

তবে মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দাবাতে পারবে না। বাংলার মধ্যে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি বলেছিলাম যাবার আগেও, বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, তোমরা তা করেছো।

আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করেছো। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, আমার বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন, আমার বহু ভাই আজ দুনিয়ায় নাই। তাদের আমি দেখব না। আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়া অনুভব করলাম।

বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা তোমায় বড় ভালোবাসি। খোদা তার জন্যই আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।

আমি আশা করি। দুনিয়ায় সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন যে আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার জনগণের খাবার নাই, আমার মানুষ গৃহহারা সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারী, তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য কর। মানবতার খাতিরে আমি তোমাদের কাছে সাহায্য চাই। দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকগনাইজ কর, জাতিসংঘে স্থান দাও।দিতে হবে। উপায় নাই, দিতে হবে। আমি, আমরা হার মানব না, মিথ্যা কথা, প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছে, দুনিয়ার ইতিহাসে স্বাধীনতার সংগ্রামে এত লোক আত্মহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি, আমার দাবায়া রাখতে পারবা না।

আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম, ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।

মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, কর্মীবাহিনী তোমাদের মোবারকবাদ জানাই। তোমরা গেরিলা হয়েছো, তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না। রক্ত বৃথা যায় নাই। একটা কথা, আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যে লোকেরা আছে, অন্যদেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, বাংলায় কথা বলে না। আজও বলছি তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি, তাদের উপর হাত তুলো না। আমরা মানুষ, মানুষ ভালোবাসি। তবে যারা দালালি করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। বিচারের দায়িত্ব বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন। একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিকের মতো স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে।আমি দেখায় দিবার চাই দুনিয়ার কাছে যে, শান্তিপ্রিয় বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপ্রিয় বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।

আমারে আপনারা পেয়েছেন, আমি আসছি। জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল।আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম,আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আইসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব, আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাব না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।

ভাইয়েরা আমার যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন। আমি সমস্ত জনসাধারণকে বলতে চাই, সেখানে রাস্তা ভেঙ্গে গেছে নিজেরাই রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই জমিতে ধান বুনাও। সব কর্মচারীদের বলে দিবার চাই একজনও ঘুষ খাবেন না। আমি দোষ ক্ষমা করব না। ভাইয়েরা আমার। যাবার সময় যখন আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তাজউদ্দিন, নজরুল এরা আমার কাছে যায়। আমি বলেছিলাম সাত কোটি বাঙালির সাথে আমাকে মরতে দে তোরা। আমি আর্শিবাদ করছি। তাজউদ্দিনরা কাঁদছিল। তোরা চলে যা, সংগ্রাম কর, আমার আত্মা রইল। আমি এই বাড়িতে মরতে চাই, এই হবে বাংলার জায়গা, এই শহরে আমি মরতে চাই। ওদের কাছে মাথা নত করতে আমরা পারব না।

ভাইয়েরা আমার, ডক্টর কামালকে নিয়ে তিন মাস পর্যন্ত সেখানে ইন্টারোগেশন হয়েছে মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দাও। কয়েকজন বাঙালি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। তাদের আমরা জানি এবং চিনি। তাদের বিচার হবে। আজ আমি বক্তৃতা করতে পারছি না। আপনারা বুঝতে পারেন। নব নব নব সুন্দরী মম, জননী জন্মভূমি, গঙ্গার তীর সিক্ত সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি। আমার জীবন। আজ যখন আমি ঢাকায় নামছি, তখন আমি চোখের পানি রাখতে পারি নাই। আমি জানতাম না, যে মাটিকে আমি এক ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, যে বাংলাদেশকে আমি এত ভালোবাসি, সেই বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা?

আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি, আমার ভাইদের কাছে, আমার মাদের কাছে, আমার বোনদের কাছে, বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলার মানুষ আজ আমরা স্বাধীন।

আমি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি, তোমরা সুখে থাকো। তোমাদের মধ্যে আমাদের ঘৃণা নাই। তোমাদের আমরা শ্রদ্ধা করতে চেষ্টা করব। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে, আমার মা-বোনের উপর রেপ করেছে। আমার ৩০ লক্ষ লোকে মেরে ফেলে দিয়েছে। যাও সুখে থাকে। তোমরা সুখে থাকো। তোমাদের সঙ্গে আর না। শেষ হয় গেছে। তোমরা স্বাধীন থাকো। আমিও স্বাধীন থাকি। তোমাদের সঙ্গে আমার স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বন্ধুত্ব হতে পারে, তাছাড়া বন্ধুত্ব হতে পারে না। তবে যারা অন্যায়ভাবে অন্যায় করেছে তাদের সম্বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হবে।

আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই। আর একদিন আমি বক্তৃতা করব। কিছুদিন পরে একটু সুস্থ হয়ে নেই। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমি সেই মুজিবুর এখন আর নাই। আমার বাংলার দিকে চাইলেই দেখেন সমান হয়ে গেছে জায়গা, গ্রাম। গ্রাম পোড়ায় দিয়েছে। এমন কোন ঘর নাই যার মধ্যে আমার লোকদের হত্যা করা হয় নাই কত বড় কাপুরুষ যে নিরপরাধ মানুষকে এইভাবে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর লোকেরা। আর তারা বলে কি আমরা পাকিস্তানের মুসলমান সামরিক বাহিনী। ঘৃণা করা উচিত। জানা উচিত দুনিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরে এই বাংলাদেশই দ্বিতীয় স্থান মুসলিম কান্ট্রি। মুসলমান সংখ্যা বেশি দ্বিতীয় স্থান। আর ইন্ডিয়া তৃতীয় স্থান, আর পশ্চিম পাকিস্তান চতুর্থ স্থান। আমরা মুসলমান। মুসলমান মা-বোনদের রেপ করে!

আমরা মুসলমান। আমরা রাষ্ট্রে এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র। এই বাংলাদেশে হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।

যারা জানতে চান, আমি বলে দিবার চাই, আসার সময় দিল্লীতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির সংগে যেসব আলোচনা হয়েছে। আমি আপনাদের বলতে পারি যে, আমি জানি তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। সে পণ্ডিত নেহেরুর কন্যা, সে মতিলাল নেহেরুর ছেলের মেয়ে। তাঁরা রাজনীতি করেছেন, ত্যাগ করেছেন। তাঁরা আজকে সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। যেদিন আমি বলব, সেইদিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে। এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু কিছু সরায় নিচ্ছেন। তবে যে সাহায্য করেছেন, আমি আমার সাত কোটি দুঃখী বাঙালির পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধিরা গান্ধিকে, তাঁর সরকারকে, ভারতের জনসাধারণকে, মোবারকবাদ জানাই। অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। ব্যক্তিগতভাবে এমন কোন রাষ্ট্রপ্রধান নাই যার কাছে তিনি আপিল করেন নাই যে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দাও। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে বলেছেন, তোমরা ইয়াহিয়া খানকে বল শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। একটা রাজনৈতিক সলিউশন করার জন্য।

এক কোটি লোক মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে গেছে। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে লোকসংখ্যা ১০ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ, ৪০ লাখ, ৫০ লাখ। শতকরা ৬০টা রাষ্ট্র আছে যার জনসংখ্যা এক কোটির কম। আর আমার বাংলা থেকে এক কোটি লোক মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতে স্থান নিয়েছিল। কত সেখানে অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছে। কত না খেয়ে, না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে।

কত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই পাষণ্ডের দল। ক্ষমা কর আমার ভাইয়েরা ক্ষমা কর। আজ আমার কারও বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নেই। একটা মানুষকে তোমরা কিছু বলোনা। অন্যায় যে করেছে তাকে সাজা দেব। আইন-শৃঙ্খলা তোমাদের হাতে নিও না।

000মুক্তিবাহিনীর যুবকরা, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ কর। ছাত্রসমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ কর। শ্রমিক সমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ কর। কৃষক সমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ কর। বাংলার হতভাগ্য হিন্দু-মুসলাম আমার সালাম গ্রহণ কর। আর আমার যে কর্মচারীরা, যে পুলিশ, যে ইপিআর, যাদের উপর মেশিনগান চালিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা মা-বোন ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছে। তার স্ত্রীদেরকে গ্রেফতার করে কুর্মিটোলা নিয়ে যাওয়া হয়েছে তোমাদের সকলকে আমি সালাম জানাই, তোমাদের সকলকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।

নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, বাংলায় মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই দেশে এই চিন্তা করেই মরতে পারি। এই দোয়া এই আশির্বাদ আপনারা আমাকে করবেন। এই কথা বলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার চাই।

আমার সহকর্মীদের সকলকে আমি ধন্যবাদ জানাই, যারা আমার, তারা একজন একজন করে তা প্রমাণ করে দিয়েছে যে না মুজিব ভাই বলে গেছে তোমরা সংগ্রাম কর, তোমরা স্বাধীন কর, তোমরা জান দাও, বাংলার মানুষকে মুক্ত কর, আমার জন্য চিন্তা কর না, আমি চললাম, যদি ফিরে আসি আমি জানি ফিরে আসতে পারবো না, কিন্তু আল্লাহ আছে, তাই আজ আমি আপনাদের কাছে ফিরে এসেছি। তোমাদের আমি, আমার সহকর্মীরা, তোমাদের আমি মোবারকবাদ জানাই। আমি জানি কি কষ্ট তোমরা করেছে। আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, নয় মাস পর্যন্ত আমাকে কাগজ দেয়া হয় নাই।

এ কথা সত্য, যাবার আসার সময় ভুট্টো সাহেব আমাকে বলেছিলেন, শেখ সাহেব চেষ্টা করেন দুই অংশের কোন একটা বাঁধন দেয়া যায় কি না। আমি বললাম আমি কিছু বলতে পারি না, আমি কোথায় আছি জানি না। আমার বাংলা, আমার মাটিতে যেয়ে আমি বলব। আজ বলছি ভুট্টো সাহেব, সুখে থাকো। বাঁধন ছুটে গেছে। তুমি যদি কোন বিশেষ শক্তির সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে আমার বাংলা স্বাধীনতা হরণ করতে চাও, এবার মনে রেখ, এবার তাদের নেতৃত্ব দেবে শেখ মুজিবুর রহমান। মরে যাবো, স্বাধীনতা হারাতে ছাড় দেব না। ভাইয়েরা আমার, আমার ৪ লক্ষ বাঙালি আছে পশ্চিম পাকিস্তানে।

আমি অনুরোধ করব তাদের, একটা জিনিস আমি বলতে চাই, তোমাদের এপ্রুভাল নিয়ে আমার সহকর্মীরা, এন্টারন্যাশনাল ফোরামে জানিসংঘের তত্ত্বাবধায়ক, অথবা ওয়াল্ড জুরিসডিকশনের পক্ষ থেকে একটা ইনকোয়ারি হতে হবে। যে কি পাশবিক অত্যাচার, কিভাবে হত্যা করেছে আমাদের লোকদের, এ সত্য দুনিয়ার মানুষকে জানাতে হবে। আমি দাবি করব জাতিসংঘকে হিউম্যান রাইটসকে, বাংলাদেশকে আসন দাও এবং একটি ইনকোয়ারি কর।

ভাইয়েরা আমার, যদি কেউ চেষ্টা করেন ভুল করবেন। আমি জানি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই। সাবধান বাঙালিরা ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই। একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি কর। বলেছিলাম, বলেছিলাম যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধ কর। বলেছিলাম? বলেছিলাম এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এই জায়গায় ৭ই মার্চ তারিখে। আজ বলে যাচ্ছি তোমরা ঠিক থাকো, একতাবদ্ধ থাকো। কারও কথা শুনো না। ইনশাআল্লাহ স্বাধীন যখন হয়েছি, স্বাধীন থাকব। একজন মানুষ এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকতে কেউ আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারবেন না।

আজ আমি আর বক্তৃতা করতে পারছি না। একটু সুস্থ হলে আবার বক্তৃতা করব। আপনারা আমারে মাফ করে দেন। আপনারা আমারে দোয়া করেন। আপনারা আমারে দোয়া করেন। আপনারা আমার সাথে সকলে আজকে একটা মোনাজাত করেন আল্লাহুমা আমিন।’

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here