মুজাহিদুল ইসলাম সোহেল।
নোয়াখালী: আজ ৭ ডিসেম্বর । নোয়াখালী মুক্ত দিবস। মুক্তিসেনারা এইদিন জেলা শহরের পিটিআই’তে রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটির পতন ঘটিয়ে নোয়াখালীর মাটিতে উড়িয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা।
দখলদার বাহিনী ও রাজাকাররা ৭১ এর বিভিন্ন সময়ে জেলা শহরের শ্রীপুর, সদরের রামহরিতালুক, গুপ্তাংক , বেগমগঞ্জের কুরিপাড়া, গোপালপুর ও আমিষাপাড়ায় নির্বিচারে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এ সময় হায়নাদাররা গুলি ও পুড়িয়ে হত্যা করে দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে। গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসাা প্রতিষ্ঠান। একই সাথে পাক হানাদার ও রাজাকাররা মেয়েদের ধরে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রাখে পাশবিক নির্যাতন করে।
মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে ও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করে । কোম্পানীগঞ্জের বামনী, তালমাহমুদের হাট, ১২ নং স্লুইস গেইট, সদরের ওদারহাট, করমবক্স, বেগমগঞ্জের ফেনাকাটা পুল, রাজগঞ্জ, বগাদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা।
নোয়াখালী মুক্ত হওয়ার আগ মুহুর্তে ৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে মাইজদী পিটিআই ও বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাইস্কুল ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানী মিলিটারিরা ও মিলিশিয়ারা। এ সময় বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কের বগাদিয়া ব্রিজ অতিক্রম করতেই সুবেদার লুৎফুর রহমান ও শামসুল হকের নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনীর অসংখ্য পাক সেনা ও মিলিশিয়া নিহত হয়।
মুক্ত দিবসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বৃহত্তর নোয়াখালীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার মিজানুর রহমান, কবি এনাম আহসান, মিয়া মোহাম্মদ শাহজাহান ও অধ্যাপক মোঃ হানিফ জানান, ৭ ডিসেম্বর ভোররাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অপারেশন শুরু করেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে থাকে রাজাকাররা। এ সময় বিপরীত দিক থেকে গুলি বন্ধ হলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে দেখতে পান সেখানে ১০-১২ জন রাজাকারের লাশ পড়ে আছে। আরো কয়েকজন রাজাকার ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। এভাবে ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় নোয়াখালী জেলা ।
৭৫ বছর বয়ষ্ক মুক্তিযোদ্ধা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী মাহফুজুল বারী জানান, নোয়াখালী মুক্ত হওয়ার আনন্দে তারা জেলা কারাগারের সব কয়েদিদের মুক্ত করে দেন।
রাজাকার ক্যাম্পে আটকে থাকা নোয়াখালী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের শ্রীপুর গ্রামের বেগম। বেগমকে দীর্ঘদিন রাজাকার ও পাক হানাদাররা শহরের নাহার কটেজ ও মাইজদি পিটিআই ক্যাম্পে আটকে রেখে অমানসিক নির্যাতন করে।
বেগম ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত হওয়ার পর বাড়িতে আসে । তার স্বজনরা জানায়, পাশবিক নির্যাতনের ফলে বেগম পাগল হয়ে যায়। কিছুদিন পর বেগমের একটি সন্তান জন্ম নেয়। সন্তানটি জন্মের পর পরই মারা যায়। এর পর পাগল অবস্থায় কোথায় যে চলে গেলো , অনেক খোঁজা খুঁজি করেও আর সন্ধান পাওয়া যায়নি বেগমের। স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও বিরঙ্গনা খেতাব পায়নি বেগম, পরিবার পায়নি সম্মান। তারা এ ঘটনার বিচার দাবী করেন।
স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর , গণকবর গুলি আজও সংরক্ষিত হয়নি । বিশেষ করে মাইজদি পিটিআই হানাদারদের ক্যাম্পে অত্যাচার ও গুলি করে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামীদের হত্যার পর জেনারেল হাসপাতালের পিছনে গর্ত করে পুঁতে ফেলত, তাদের কবরগুলোও সংরক্ষিত হয়নি।
নানা কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে দিনটি পালন করবে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিজয়মেলা কমিটি, সম্মিলিত সাংষ্কৃতিক জোট। এ উপলক্ষে মাইজদি পিটিআই সংলগ্ন মঞ্চে আলোচনা সভা, মুক্তিযুদ্ধের গান ও র্যালী অনুষ্ঠিত হয়।